নাটোর: প্রায় সারা বছরই এই গ্রামের ফসলের মাঠ, পুকুর পাড়, আম, কাঁঠাল, শিমুল, তেঁতুল, খেজুর, তালগাছ আর বাঁশঝাড় সবখানেই হরেক প্রজাতির পাখির দেখা মেলে।
দেশীয় নানা প্রজাতির পাখির সঙ্গে শীতের শুরুতেই এসে যোগ দেয় ঝাঁকে-ঝাঁকে পরিযায়ী পাখি।
এতে করে নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার সমসখলসী নামে এই গ্রামটি এখন পরিচিত ‘পাখি গ্রাম’ হিসেবে।
সম্প্রতি সরেজমিনে ওই গ্রাম ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, এ গ্রামের বিভিন্ন খাল, পুকুর, ঝাড় ও গাছে পাখিদের বিচরণ ও আবাস। ফলে প্রতিদিন পাখির কিচিরমিচির শব্দে আর কলকাকলিতে ঘুম ভাঙে গ্রামবাসীর।
গ্রামের বিভিন্ন স্থানে শামুকখোল, পানকৌড়ি, দোয়েল, ঘুঘু, শালিকসহ নানান জাতের দেশি পাখির দেখা মেলে। সেইসঙ্গে শীতপ্রধান অঞ্চল থেকে আসা পরিযায়ী পাখি দেখা যায়। পরিযায়ী পাখির মধ্যে অধিকাংশই ছোট সরালি, বড় সরালি, খঞ্জনা, পাতিহাঁস প্রজাতির।
এসব পাখি স্বাচ্ছন্দ্যে গাছে বিতরণ করে। ঝাঁকে-ঝাঁকে ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় ইচ্ছেমতো। উপযুক্ত পরিবেশ ও নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে নির্ভাবনায় আবাস গড়ে তোলে পাখিরা।
এই পাখি গ্রামের মানুষেরাও প্রকৃতিপ্রেমী। পাখির প্রতি ভালোবাসা থেকে পাখি রক্ষায় নানা উদ্যোগও নিয়েছেন তারা। ফলে পাখির অভয়ারণ্য হয়ে ওঠা সমসখালীতে প্রতিদিন আসছেন পর্যটকরা।
এলাকাবাসী জানান, নাটোর জেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে নিভৃত এই গ্রামে ২০০৫ সালের দিকে প্রথম পরিযায়ী পাখির আনাগোনা শুরু হয়। সেইসঙ্গে আগে থেকেই এখানে দেশীয় প্রজাতির আধিক্য ছিল। প্রথম প্রথম অনেকেই আশপাশের গ্রাম থেকে এ গ্রামে পাখি শিকার করতে আসলেও এলাকাবাসীর বাধার মুখে ব্যর্থ হন। পরে পুরো গ্রামের লোকজন পাখি নিধন বন্ধে গ্রামের বিভিন্ন পয়েন্টে ব্যানার, সাইনবোর্ড টাঙান ও লিফলেট বিলি করেন। একপর্যায়ে পাখি রক্ষায় তারা স্থানীয় থানা পুলিশের সহায়তা নেন।
পরবর্তীতে গ্রামের যুবকরা নিজেদের উদ্যোগে গ্রামটিকে পাখির নিরাপদ আবাসস্থল (অভয়াশ্রম) হিসেবে ঘোষণা করেন।
এদিকে, পাখির সার্বিক নিরাপত্তা ও বংশ বিস্তারে স্থানীয় যুবকদের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘ইয়ুথ সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ নামে পরিবেশবাদী একটি সংগঠন। এই সংগঠনের কর্ণধার জুয়েল রানা নামে স্থানীয় এক তরুণ।
গ্রামের পাখিপ্রেমী যুবক জুয়েল রানা ও সাবেক শিক্ষক বিরল কুমার জানান, প্রতিবছর পরিযায়ী পাখিরা এ সময় আসে। এসব পাখির বিষ্ঠা নিয়ে কিছুটা বিপত্তি ঘটলেও এখন তারা সব সয়ে গেছেন। গ্রামের সবাই পাখির প্রতি মমতাশীল।
এদিকে, দিন দিন ‘পাখি গ্রামের’ পরিচিতি বাড়তে থাকায় এখন অনেকেই আসেন পাখি দেখতে।
পাখি দেখতে আসা রাজশাহীর আবির হোসেন, সুমনা পারভিন জানান, পাখি দেখে তারা মুগ্ধ। পাখি দেখতে দর্শনার্থীদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা দরকার বলে তারা মন্তব্য করেন।
নলডাঙ্গা উপজেলা কৃষি অফিসার আমিরুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, পাখিরা শুধু পরিবেশের ভারসাম্য ও জীব-বৈচিত্র্য রক্ষাসহ কৃষির বিরাট উপকার করছে। পাখির বিষ্ঠা জৈব সার ও ক্ষতিকারক পোকা-মাকড় দমনে উপযোগী।
রাজশাহী বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবুল কালাম জানান, ওই গ্রামের পাখি রক্ষায় রাজশাহী বন বিভাগের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগ গ্রামবাসীকে নানাভাবে পরামর্শ ও সহযোগিতা করে আসছে।
এসব বিষয়ে নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শারমিন আক্তার জাহান জানান, সমসখলসী গ্রামের পাখি সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারটি উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নজরদারি করা হচ্ছে। পাখি পরিচিতি ও পাখিপ্রেমীদের উদ্বুদ্ধ করতে খুব শিগগিরই সেখানে তিন দিনের পাখি মেলা ও প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০১৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০১৬
এসআর