বগুড়া: ঋতু বৈচিত্র্যের ধারায় কার্তিক-অগ্রহায়ণ হেমন্তকাল। হেমন্তের আগমনী বার্তায় খেজুর গাছ নিয়ে নড়েচড়ে বসেন গাছিরা।
প্রথমে গাছের মাথা থেকে প্রয়োজনীয় ডালপালা ছেটে ফেলে দেন গাছিরা তার কয়েকদিন পরে রস বেরুনোর স্থান হালকা করে কেটে পরিষ্কার করেন।
কিছু দিন বিরতির পর আবার কয়েক দফায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে ছেটে ফেলা হয় গাছের ছাল। যখন গাছি বুঝতে পারে গাছে রস ঝরা শুরু হয়েছে তখন এক পর্যায়ে গাছির দক্ষ হাতের ছোঁয়ায় পাওয়া যায় খেজুরের রস।
খেজুর গাছের সঙ্গে মাঝা শক্তভাবে দড়ি দিয়ে বাঁধা। পেছনে ঝুলছে মাটির পাত্র। কখনো কখনো বাঁশের তৈরি ঝুড়ি গাছির পেছনে ঝুলতে দেখা যায়। যার মধ্যে গাছ কাটার বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি রাখা হয়।
গাছ কাটা শেষে যখন রস ঝরতে শুরু করে তখন গাছের মাথার অংশে বাঁশের তৈরি দুটো চোখা ছোট খুঁটি পোতা হয় রসের হাড়ি ঝুলানোর জন্য। রস হাড়ির মধ্যে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ার জন্য বাঁশের তৈরি নালার মত আরেকটি খুঁটি পুতে দেওয়া হয় গাছে।
আবুল কালাম আজাদ, লোকমান হোসেনসহ কয়েকজন গাছি বাংলানিউজকে জানান, প্রতিদিন বিকেলে গাছের মাথায় ছ্যান দিয়ে হালকাভাবে ছেটে দেওয়া হয়। এর পরে সেখানে মাটির হাড়ি বেঁধে রাখা হয়। পরদিন কাকডাকা সকালে সেই হাড়ি গাছ থেকে নামানো হয়। গাছভেদে ৩-৫কেজি রস পাওয়া যায় বলে জানান গাছিরা।
পতিত জমি, ভিটা, জমির আইলসহ বিভিন্ন স্থানে খেজুর গাছ দেখা যায়। আপনা আপনি এসব গাছ জন্ম নিয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে কেউ এসব গাছ লাগায়নি। একটি সময় এ জেলায় বিপুল সংখ্যক খেজুর গাছ ছিল। তবে সময়ের ব্যবধানে গাছগুলো কেটে ফেলছেন বেশির ভাগ মানুষ। এরপরও অনেক গ্রামে এখনো প্রচুর খেজুর গাছ রয়েছে বলেও জানান ওসমান, সুকুমার, আব্দুস সালাম একাধিক গাছি।
এসব গাছি বাংলানিউজকে জানান, অগ্রহায়ণ মাস থেকে খেজুর রস সংগ্রহ করা শুরু হয়। সপ্তাহে দুই তিন দিন বিরতি রেখে রস সংগ্রহ করা হয়। এতে বেশি রস উৎপাদন হয়।
শীতের সকালে খেজুর রসে মুড়ি ভিজিয়ে খায় অনেকেই। এ সময় খেজুরের রস দিয়ে গ্রামের ঘরে ঘরে খেজুর রসের পায়েস, পিঠা-পুলি তৈরির ধুম পড়ে যায়। খেজুরের রস খাওয়ার উৎসব ভাগাভাগি করতে জামাই-মেয়ে ও স্বজনদের নিমন্ত্রণ করে বাড়ি বাড়ি চলে শীতের রকমারি পিঠা উৎসব। এছাড়া খেজুর রস দিয়ে লালি, দানাদার ও পাটালি গুড় বানানো হয়। গুড়ের স্বাদ-গন্ধে ভরে ওঠে সবার মনপ্রাণ।
খেজুরের রস গ্রাম বাঙলার ঐতিহ্যের অংশ হয়ে আজো টিকে রয়েছে। তবে সময়ের ব্যবধানে পরিসর অনেক কমে এসেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বগুড়া জেলার ১২টি উপজেলায় প্রায় অর্ধলাখ খেজুর গাছ রয়েছে। এর মধ্যে নন্দীগ্রাম, শাজাহানপুর, আদমদীঘি, শেরপুর, শিবগঞ্জ উপজেলায় এ খেজুর গাছের সংখ্যা বেশি। তবে খেজুর গাছের বয়স বাড়ার কারণে সব গাছ থেকে রস উৎপাদনও হয় না। আবার কিছু কিছু খেজুর গাছ আছে দেখতে অনেক মোটা তাজা হলেও সেই গাছ থেকে রস পাওয়া যায় না।
বাণিজ্যিকভাবে খেজুর রস উৎপাদনে এখনো কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংশ্লিষ্ট বিভাগ এগিয়ে আসেননি। গ্রাম বাঙলার এ ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে অদূর ভবিষ্যতে কেউ এগিয়ে আসবেন কী-না তা নিয়েও রয়েছে যথেষ্ট সন্দেহ-সংশয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আব্দুর রহিম বাংলানিউজকে জানান, নভেম্বর থেকে শুরু করে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ চার মাস খেজুর রস সংগ্রহ করা যায়। ইতোমধ্যেই জেলার বিভিন্ন উপজেলায় গাছিরা এ রস সংগ্রহ শুরু করেছেন। এ জেলায় প্রায় অর্ধলাখ খেজুর গাছ রয়েছে।
তবে কেউ বাণিজ্যিকভাবে খেজুর গাছ চাষ করেন না। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান খেজুর গাছ বাণিজ্যিকভাবে চাষের উদ্যোগ নিলে কৃষি বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ সহায়তা দেওয়া হবে বলেও জানান কৃষিবিদ আব্দুর রহিম।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০১৬
এমবিএইচ/আরআইএস/আরআই