ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ঢাকা টু সিলেট

জার্নি বাই পারাবত এক্সপ্রেস

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১, ২০১৬
জার্নি বাই পারাবত এক্সপ্রেস

ঘড়ির কাঁটা তখন সোয়া ৬টা ছাড়িয়েছে। পারাবত এক্সপ্রেস ছাড়ার বাকি মাত্র ২০ মিনিট। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের ডিজিটাল স্ক্রিনও ঠিক সেটাই দেখাচ্ছিল। কিন্তু কোন প্লাটফর্ম থেকে ট্রেনটি ছাড়বে, স্ক্রিনের সেই কলামটাই ফাঁকা। অর্থাৎ কোথায় দাঁড়াতে হবে সেটাই থাকলো আজানা।

পারাবত এক্সপ্রেস থেকে: ঘড়ির কাঁটা তখন সোয়া ৬টা ছাড়িয়েছে। পারাবত এক্সপ্রেস ছাড়ার বাকি মাত্র ২০ মিনিট।

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের ডিজিটাল স্ক্রিনও ঠিক সেটাই দেখাচ্ছিল। কিন্তু কোন প্লাটফর্ম থেকে ট্রেনটি ছাড়বে, স্ক্রিনের সেই কলামটাই ফাঁকা। অর্থাৎ কোথায় দাঁড়াতে হবে সেটাই থাকলো আজানা।

এরপর আরও মিনিট দশেক কেটে গেলো। কিন্তু তখনও স্ক্রিনে প্লাটফর্মের কলাম ফাঁকা। বেশ কয়েকজন যাত্রীকে দেখা গেলো ট্রেনের অবস্থান জানতে হন্তদন্ত হয়ে এদিক-সেদিক ছুটতে। মনিটরের নিচেই বসা রেলওয়ে পুলিশের হেল্প ডেস্ক। সেখানে বসা একজন পুলিশ সদস্যের কাছে সিলেটগামী ট্রেনটির অবস্থান জানতে চাইলে ভদ্রলোক বললেন, দ্রুত এক নম্বরে যান। ওখানে ট্রেন দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাড়বে।

বিশ্রামাগার থেকে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়ানো চকচকে নতুন লাল-সবুজ ট্রেনটি। পড়িমড়ি ছুটলেন যাত্রীরা। এর মধ্যে বয়স্কদের একটু বেশিই নার্ভাস দেখাচ্ছিল তখন। যথা সময়েই হুইসেল দিয়ে যাত্রা করলো পারাবত এক্সপ্রেস। কেউ ধরতে ব্যর্থ হলেন কিনা জানা গেলো না।

অথচ এই ট্রেনটি প্রায় ৬ ঘণ্টা আগে থেকেই এক নম্বর প্লাটফর্মে দাঁড়ানো। এটি প্রতিদিন (মঙ্গলবার ছাড়া) সকালে ঢাকা থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। আবার বিকেলে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে রাত সাড়ে ১০টায় পৌঁছে যায়।

সে হিসেবে সারারাত ধরে ট্রেনটি এক নম্বরে দাঁড়ানো। কিন্তু মনিটর ফাঁকা। যে কাজটি কম্পিউটারের একটি বাটন চেপেই করা যায়। সেই কাজটি করতেই অনীহা মনে যেন বাংলাদেশ রেলওয়ের। যার কারণে যাত্রীদের এতো পেরেশানি!

সাধারণত যাত্রা পথের স্টেশনগুলোতে ২০ মিনিট আগে ট্রেনের বিস্তারিত তুলে ধরা হয় ডিজিটাল স্ক্রিনে। এমনকি মাইকেও ঘোষণা দেওয়া হয়। আর প্রথম স্টেশনে কমপক্ষে ৩০ মিনিট আগে ঘোষণা দেওয়া হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশে আরও অনেক আগেই শিডিউল প্রকাশ করা হয়। কিন্তু বৃহস্পতিবার (০১ ডিসেম্বর) ভোরে বাংলাদেশের প্রধান রেলওয়ে স্টেশনেই এর চ্যুতি দেখা গেলো। না ছিল মাইকিং, না ছিল স্ক্রিনে।

ট্রেনটির পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মোটামুটি সন্তুষ্ট হওয়ার মতো। কিন্তু কামরায় ময়লা ফেলার ঝুড়ি নেই। বেশিরভাগ বগি এমনকি কেবিনেও কোনো ময়লা ফেলার ঝুড়ি রাখা নেই। যে কারণে যাত্রীদের কেউ বাধ্য হয়ে আবার কেউ কেউ ইচ্ছে করেই টিস্যু ও খাবারের উচ্ছিষ্ট ট্রেনের মধ্যেই ফেলছেন। অথচ প্রত্যেকটি বগি আর কেবিনেই স্টিকার ঝুলছে, ‘ময়লা আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলুন’।

সিলেটবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিল একটি এসি ট্রেনের। সেই দাবি পূরণ হয়েছে সম্প্রতি। কিন্তু সেই এসি ট্রেনে উটকো ঝামেলা জুড়েছে ক্যাটারার্স সার্ভিস। হকারের উৎপাত থেকে বাঁচতে মেসার্স ওবায়দুল হক অ্যান্ড সন্সকে ক্যাটারিংয়ের (ট্রেনের খাবার বিক্রি) ইজারা দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু সেই সার্ভিসের উৎপাতে অতিষ্ঠ যাত্রীরা। এমনকি কেবিনে টিকিট কেটেও রক্ষা হচ্ছে না বলে জানালেন তোফাজ্জল নামে এক যাত্রী। তিনি জানান, একটু পরপর এসে দরজায় হাঁক দিচ্ছে, চা-কফি, চিপস, চকলেট, নাস্তা বলে। শুধু হাঁক দিয়ে যদি ক্ষ্যান্ত দিতো তাহলে রক্ষে ছিল। হাঁক দিয়ে সাড়া না পেলে দরজায় টোকা দিচ্ছে। আবার ধপাস করে দরজা খুলে জানতে চাইছে কিছু লাগবে কি না।

‘গ’ বগির ‘২’ নম্বর কেবিনে বসে এক যাত্রীর সঙ্গে আলাপকালেই পাওয়া গেলো তার অভিযোগ। একজন এসে চকলেট, চিপস হাঁক ছাড়তে ছাড়তে হেঁচকা টানে খুলে ফেললেন কেবিনের দরজা। ক্যাটারিং সার্ভিসের বিশেষ ড্রেস পরা খোরশেদ নামের এই ব্যক্তির কাঁধে ঝোলানো ঝাঁপিতে চকলেট, বিস্কুট, চানাচুরের পসরা। জানতে চাইলেন কিছু লাগবে কি-না।

এভাবে বাইরে থেকে হেঁচকা টান দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে বললেন, দরজা লক করা ছিল না বলে খুলে ফেলেছি। খোরশেদ আলমের প্রস্থানের পর চা-কফি নিয়ে হাজির হলেন মো. আমিন। তিনি অবশ্য হেঁচকা টান দিলেন না। নক করলেন ঠিক যেন জরুরি কাজে এসেছে কেউ। দরজা খোলার পর চা-কফি সাধলেন। ভদ্রলোক খেতে চাইলেন চা। কিন্তু আমিন সাহেব গছাতে চাইলেন কফি। শেষে চায়েই হলো সমাধা।

এভাবে দরজা নক করা ও চাপাচাপির কারণ জানতে চাইলে আমিন জানান, বেচাকেনা না হলে মালিক আমাদের বেতন দিবে কিভাবে? সে কারণে বিক্রি বাড়ানোর জন্য আমরা চেষ্টা করি। তবে কেউ নিষেধ করলে সেই কেবিনে যাই না।

তিনি জানালেন, মেসার্স ওবায়দুল হক অ্যান্ড সন্স ক্যাটারিং সার্ভিসের মোট ২২ জন কর্মী রয়েছেন এই ট্রেনে। এর মধ্যে দু’দিকে দু’টি ক্যান্টিনে রয়েছেন দু’জন। আর ২০ জন রয়েছেন ভ্রাম্যমাণ। যারা ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেন।

বগিটির (গ) পরেই ‘ঘ’ বগি। আর ‘ঘ’র পরে পাওয়ার কার। পাওয়ার কারের সামনে গিয়ে চক্ষু স্থির। রেলের একজন কর্মী পাওয়ার কারের বগিতে থাকা কেবিন স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে অভিনব কায়দায় খুলে একজনকে ভেতরে যেতে নির্দেশ দিলেন।

সামনাসামনি হতেই ভারি গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাবেন? সিলেট বলতেই, পাল্টা প্রশ্ন টিকেট আছে? আছে। আবার বললেন, সিট নাই স্ট্যান্ডিং! তাহলে দু’শ টাকা দেন। এখানে বসে আরামে যেতে পারবেন। আগের জন দু’শ টাকা দিয়ে গেছেন সেটাও দেখালেন পকেট থেকে বের করে।

পারাবত চলছে থেমে থেমে। স্টেশনের বাছ বিছার নেই। যখন তখন দাঁড়িয়ে পড়ছে। কখনও কখনও স্টেশনের কিছুদূর আগে। কখনও চা বাগান কিংবা সোনালী ধানক্ষেতের মাঝে।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০১৬
এসআই/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।