পারাবত এক্সপ্রেস থেকে: ভাঙা আয়নায় মুখ দেখলে নাকি অমঙ্গল হয়। প্রচলিত এই কথার মতো ‘ভাঙা আয়না’র অমঙ্গলজনক নজর পড়েছে যেন ঢাকা-সিলেট রুটে চলাচলকারী দেশের অন্যতম অভিজাত ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেসের দিকে।
এই তো ১ সেপ্টেম্বর কী ঝকঝকে-তকতকে প্রথম শ্রেণি (কেবিন), এসি চেয়ার ও শোভন চেয়ার মিলিয়ে মোট ১৬ বগির ৭১৯ আসন বিশিষ্ট পারাবত যাত্রা করলো। মাস তিনেক পেরোনোর আগেই সেই পারাবতের কেবিনে এখন ‘ভাঙা আয়না’। ‘ঘ’ বগির ‘৭’ নম্বর কেবিনের সেই ভাঙা আয়না দেখেই মনে হলো, দেখা দরকার কী দশা সিলেটবাসীর বহুলকাঙ্ক্ষিত এই ট্রেনের। তারপর আধাঘণ্টার মতো ট্রেনের এ মাথা-ও মাথা হেঁটে ‘অমঙ্গলের নজির’ ছাড়া কিছুই চোখে পড়লো না।
কেবিন দিয়েই শুরু হোক। প্রত্যেকটি কেবিনের একাধিক স্থানে সেঁটে দেওয়া হযেছে ‘ময়লা আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলুন’। অথচ ‘গ’ বগির ‘৭’ নম্বর কেবিনে ময়লা ফেলার জন্য ঝুড়ি ট্রেনের এক কর্মচারীকে ডেকে চেয়েই নিতে হলো। ঠিক এমন দশা অন্য কেবিনগুলোতেও। কেবিনগুলোর পাশে আছে টয়লেট এবং হাত-মুখ ধোয়ার জন্য বেসিন। কিন্তু না টয়লেটে দেখা গেল সাবান, না দেখা গেল বেসিনে। বেসিনে অবশ্য হ্যান্ডওয়াশিং লিকুইডের জন্য একটা যন্ত্র ফিট দেখা গেল, কিন্তু কেবিনসহ পুরো ট্রেনের প্রায় ৭-৮টি বেসিনের ওই যন্ত্রখানা চেপে কিছু বেরোতে দেখা গেলো না। তবে টয়লেটগুলো থেকে বেরোচ্ছিল উৎকট গন্ধ।
এসি, নন এসি কোচে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার আরও বেশি নির্দেশনার স্টিকার। ‘খাবারের উচ্ছিষ্ট গাড়িতে না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলুন’, ‘গাড়ির অভ্যন্তরে পরিচ্ছন্ন রাখিতে সহায়তা করুন’ ইত্যাদি। কিন্তু প্রায় পুরো ট্রেন ঘুরে কোনো এসি-নন এসি কোচে ময়লা আবর্জনার ঝুড়ি দেখা গেলো না। এসি কোচের যাত্রীদের ময়লা আবর্জনা ফেলার ক্ষেত্রে খানিকটা সচেতনতা দেখা গেলেও, নন এসি কোচের যাত্রীরা সিটের তলে তলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলছিলেন বিস্কুট, চানাচুর, চিপসের প্যাকেট, কলার চামড়া আর কমলার খোসাসহ যাবতীয় আবর্জনা। অথচ প্রথম যাত্রার সময় ট্রেনের সব কেবিনে একটি করে আর প্রত্যেক এসি-নন এসি কোচে দু’টি করে ঝুড়ি ছিল।
আর পুরো ট্রেনের সব স্থানেই দেখা গেল ‘নো স্মোকিং’ ‘ভ্রমণকালীন ধূমপান হইতে বিরত থাকুন, ইহা শাস্তিযোগ্য অপরাধ’ ইত্যাদি লেখা। অথচ নন এসি কোচে হরেক রকমের সিগারেট বিক্রি করতে দেখা গেল এক হকারকে। শুধু তাই নয়, রেলওয়েকে ধূমপানমুক্ত ঘোষণা করা হলেও খোদ রেলওয়েরই এক কর্মচারীকে দেখা গেল দুই কোচের সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে ধূমপান করতে। ক্যামেরায় ছবি তোলার প্রস্তুতি দেখে বুঝে যান চতুর ওই কর্মচারী, কিন্তু সিগারেট বিক্রেতা তার বেচাকেনা চালিয়ে যেতে যেতেই পোজ দিচ্ছিলেন সোৎসাহে। অবশ্য নাম জানতে চাইলে সংবাদকর্মী বুঝতে পেরে বলে ওঠেন, ‘ভাই আমার নাম দিয়েন না’।
‘ভাঙা আয়নার পারাবত’ নিয়ে যাত্রীরা কী ভাবছেন” কথা হলো সিলেটেরই যাত্রী আহমেদ সায়েমের সঙ্গে। ট্রেনের নানা জায়গার ময়লা-আবর্জনার ছবি তুলতে দেখে তিনিই উৎসাহভরে বলছিলেন, ‘তোলেন ভাই তোলেন, অনেক আশা-ভরসার এই ট্রেন তিন মাস না গড়াতেই অবজ্ঞা-অবহেলায় পড়ে গেছে। ’
তিনি বলছিলেন, ‘সিট ছেড়ে একটু ঘোরার জন্য দুই বগির সংযোগস্থলে এসে হেলান দিলে দেখা যায় জামায় ময়লা লেগে গেছে। ’ সায়েমেই এবার বাতলে দেন ট্রেনের জানালা পরখ করে দেখার জন্য, যেই কাঁচের জানালা যাত্রার সময়ও চকচক করছিলো। কেউ দেখার নেই বলে এখন যেন ধুলো-বালির স্তর জমে গেছে। সায়েমের কথা মতো ট্রেনের বডিতে চোখ বুলিয়েও দেখা গেল লাল-সবুজ রঙের চেয়ে এখন বেশি ‘উজ্জ্বল’ ধুলো-বালিই। কোচের সংযোগস্থলগুলোর কোথাও কোথাও চা বিক্রির স্টল বসানোয় সেসব স্থানের দশা আরও রুগ্ন।
এই পারাবতকে কী আসলেই দেখার কেউ নেই? এ নিয়ে আলাপ হচ্ছিল একজন পরিচালক ও চালকের সঙ্গে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই পরিচালক অনেকটা ক্ষোভ ঝেড়েই বললেন, ‘ভাই, এইগুলা বললে তো আমার চাকরি ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। ট্রেনটা সকালে ঢাকা থেকে সিলেট যায়, আবার সিলেট থেকে রাতে ঢাকা ফিরে। ঢাকা আসার পর সকাল পর্যন্ত অনেক লম্বা সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার জন্য হাতে থাকে। এ নিয়ে নানাভাবে সিসিএমকে (চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার-পূর্ব) বলাও হয়েছে। কিন্তু তিনি মনে করেন, এই ট্রেনের কোচগুলো ইন্দোনেশিয়া থেকে কিনে বাংলাদেশ ঠকেছে। তেমন কোচ হলে যত্ন নেওয়া যেতো। ’
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না করার ক্ষেত্রে এটা কি কোনো যুক্তি? নাকি একেবারেই দায়িত্বে অবহেলা? এমন প্রশ্ন করা হলে ওই পরিচালক কেবল মুচকি হেসে ওঠেন। হাসিটা যেন সেই ‘ভাঙা আয়নার’ই প্রতীক।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০১৬
এইচএ/জেডএস