যশোর: ড্রাইভিং সিটের হেলান দেওয়ার জায়গার এক খাবলা নেই। স্টিয়ারিংটি অনেকটা শূন্যে দাঁড়িয়ে।
১৯৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত মোমিন গার্লস স্কুলে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত অনেক স্মৃতিবহুল এ গাড়িটি পড়ে আছে অরক্ষিত অবস্থায়। সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না করে বরং ময়লার ভাগাড় বানিয়ে রেখেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। স্কুলের বর্তমান কোনো শিক্ষকই বলতে পারলেন না গাড়িটি সম্পর্কে। ‘নতুন এসেছি’ বলে দায় এড়িয়ে গেলেন অনেকে।
যশোর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার রাজেক আহমেদের মুক্তিযুদ্ধের গল্পে বারবার আসছিল একটি মাইক্রোবাসের কথা। একইসঙ্গে এর চালক সিদ্দিকের কথা। তার কথার সূত্র ধরে গাড়িটি আছে কিনা জানতে চাইলে তিনিই জানান প্রথম। সেই আগ্রহ থেকেই দেখতে যাওয়া, একইসঙ্গে অনেক খুঁজে বের করা গেল চালক ‘সিদ্দিক চাচাকে’।
যশোর শহর থেকে ২ কিলোমিটার দূরের গ্রাম নূরপুরে গিয়ে খুঁজে পাওয়া যায় তাকে। এখনও তিনি গাড়ি চালান। তবে এই গাড়ি আর সেই গাড়ির ব্যবধান অনেক। ১৯৬৯ সালের জার্মানির ভক্সেল ভিভার থেকে ৪৭ বছরের ব্যবধানে তার হাতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার স্টিয়ারিং।
যে ভক্সেল ভিভারের টানে তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের মন্ত্রী অ্যাডভোকেট মশিউর রহমানের টয়োটা জিপ চালানোর চাকরি ছেড়েছিলেন, সেই প্রাণের গাড়িটি আজ পড়ে আছে মুখ থুবড়ে। বয়স হলে সেটা হতেই পারে। কিন্তু এর সঙ্গে যে তার রয়েছে জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম সময়ের স্মৃতি!
ভক্সেল ভিভারের স্বপ্নে বিভোর থাকা সেই সিদ্দিক চাচা এখন চালান এ ব্যাটারিচালিত অটো।
মশিউর রহমানের সঙ্গে অনেক ভালো সম্পর্ক ছিল তার। তখন বয়স ১৮-২০ হবে। তার জিপ গাড়ি চালাতেন সেসময়। মশিউর রহমানের সহধর্মিনী মাহমুদা রহমান তখন মোমিন সরকারি স্কুলের হেড মিস্ট্রেস। একদিন জানতে পারেন জার্মানির ভক্সেল ভিভার গাড়িটি সরকার স্কুলকে দেবে। সঙ্গে সঙ্গে ম্যাডামের কাছে আগ্রহ প্রকাশ করেন ওই গাড়ি চালানোর। তখন মাহমুদা বলেন, ‘তোমার স্যার তো ক’দিন পর মন্ত্রী হবে। তুমি এ চাকরি কি করবা!’ সিদ্দিক চাচা তখন বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে ঢুকে থাকলে তো স্যারের কাছে বদলি হয়ে যেতে পারবো। ’
মশিউর রহমানকে রাজি করিয়ে শেষ পর্যন্ত ওই গাড়ি চালানোর চাকরি নেন। ঢাকা থেকে গাড়িটি চালিয়েও নিয়ে যান তিনি।
মশিউর ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহচর। বহু আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গী। সেই সূত্রে বঙ্গবন্ধু কয়েকবার যশোর গেলে দেখা হয় তার সঙ্গে। অনেকবার এই গাড়িতে করে চোরা পথে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গেছেন বিভিন্ন সমাবেশে। বঙ্গবন্ধুপুত্র শেখ কামালের সঙ্গেও অনেকবার দেখা হয়েছে তার। ড্রাইভার হলেও বন্ধুর মতো ছিলেন বলেই বক্তব্য তার। ৩২ নম্বরের বাড়িতেও গেছেন।
১৪ সিটের মাইক্রোতে ২০-২৫ জন ছাত্রীও আনা-নেওয়া করেছেন সিদ্দিক চাচা। গাড়িটি নাকি খুবই আকর্ষণীয় ও সুন্দর ছিল।
একাত্তরের ২৪ মার্চ মশিউর রহমানের সঙ্গে শেষ কথা হয় সিদ্দিকের। তিনি পালিযে যেতে বলেন পরিবারসহ। মশিউর রহমানের স্ত্রী মাহমুদা ওই গাড়ি নিয়েই পালিয়ে যান দুই ছেলে দুই মেয়ে নিয়ে চাঁচুড়িয়া। ২৫ মার্চ গ্রেফতার হন মশিউর রহমান। যশোর সেনানিবাসে আটক রেখে ২৩ এপ্রিল তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
এর কিছুদিন পর মাহমুদা ম্যাডাম খবর দেন সিদ্দিক চাচাকে। তখন চাঁচুড়িয়া গিয়ে প্রিয় গাড়িটি নিয়ে আসেন। গাড়িটার প্রতি খুব টান ছিল। কলকাতায়ও গেছেন এ গাড়ি নিয়ে। অনেকে তখন কিনে নিতে চাইতো। অথচ তিনি গাড়ির দামই জানতেন না।
গাড়িটির পেছনের দিকের সিটে এভাবেই ফেলা হয়েছে ময়লা-আবর্জনা।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ২ মাস পর থেকে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা রাজেক আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় সিদ্দিকের। রাজেক আহমেদই গাড়িটা মূলত যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করা শুরু করেন। সেসময় অস্ত্র বহন, মুক্তিযোদ্ধাদের এক জয়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কাজে ব্যবহার হতো গাড়িটি। একবার মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার রহমানের মাথায় মর্টারের শেল লাগলে তাকে নিয়ে কলকাতায়ও যান সিদ্দিক।
যুদ্ধ তখন প্রায় শেষের দিকে। গাড়িটি নিয়মিতই লাগছিল যুদ্ধের নানাবিধ কাজে। গাড়ি চালাতেও হতো খুব সাবধানে। কোন সময় আবার খানসেনাদের সামনে পড়তে হয়!
একবার রাজেক আহমেদের সঙ্গে যাচ্ছিলেন যশোর থেকে মধুপুর। সরাসরি রাস্তা ছিল না। যেতে হবে কনেসপুর দিয়ে ঘুরে। সামনে একটা কালভার্ট পড়ল। ওই এলাকা আবার ছিল বিহারি অধ্যুষিত। হঠাৎ সামনে পড়লো ৬ পাকিস্তানি। গাড়ির স্টার্টও বন্ধ হয়ে গেল। রাজেক আহমেদ কিছু না ভেবেই ফায়ার শুরু করেন। তখনও তিনি জানতেন না পিছনে কোনো মুক্তিযোদ্ধা আছে কিনা। সিদ্দিক তখনও গাড়িতে বসে। হাতে একটি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল। কিছু অস্ত্র-ট্রেনিং তিনি নিয়ে রেখেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে চলাফেরা করতে করতেই।
গুলির দাগ
‘জায়গাটি ছিল ফাঁকা। রাস্তার পাশে ছিল শুধু একটি ছোট খেজুরগাছ। সেখানে লুকিয়েই চলছিল ফায়ার। ভাগ্য ভালো ছিল ফায়ারের শব্দ শুনে পিছন থেকে মুক্তিযোদ্ধা মনা যোগ দেয়। পাকিস্তানি ৬ জনও কেন যেন যুদ্ধ করতে চাচ্ছিল না। ‘ওরা হয়তো ভেবেছিল আমরা সংখ্যায় অনেক। ’--বলছিলেন তিনি।
কিছুক্ষণ পর তিনজন খানসেনাকে আটক করা হয়। গাড়িতে মাল লোড করার মতো করে তাদের বেঁধে তোলা হয় গাড়িতে। ওদের যখন তোলা হলো তখন ওদের কাছে চায়নিজ বড় রাইফেল ছিল। লোড করা ছিল এটা বুঝতে পারেননি রাজেক কিংবা সিদ্দিক। রাইফেলগুলো রাখেন সামনের সিটের পাশে। কিন্তু হঠাৎ কীভাবে যেন চাপ লেগে গুলি বেরিয়ে যায়। ঠিক কানের পাশ দিয়ে ছুটে যায় গুলি। বেরিয়ে যায় ছাদ ফুঁড়ে। ভাগ্যগুণে সেদিন মারা যাননি সিদ্দিক।
মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মেলেনি সিদ্দিকের। জেনারেল ওসমানীর দেওয়া সার্টিফিকেটিও নাকি পুড়িয়ে ফেলেছিলেন অন্যের মিথ্যা ভয় দেখানোয়।
যুদ্ধের পরও বছর দুয়েক চালিয়েছিলেন গাড়িটি। আর ৮০ সালের দিক থেকেই সম্ভবত স্কুলে পড়ে আছে গাড়িটি। প্রথমে গ্যারেজে থাকলেও পরে ফেলে রাখা হয় পিছনের দিকে।
যুদ্ধের এতো বছর পরও কেউ উদ্যোগ নেয়নি গাড়িটি সংরক্ষণের।
সহযোগিতায়:
আরও পড়ুন:
**মল্লযুদ্ধেই মুক্ত সীমান্তগ্রাম মুক্তিনগর
বাংলাদেশ সময়: ০০০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২ , ২০১৬
এএ/জেএম