ঢাকা: নরকের দরজা...দ্য ডোর টু হেল এই হিসেবেই কারাকুমের পরিচয়। কালো বালুর সদা তপ্ত এক মরুভূমি।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিজি-১০১১-এর পাইলট যখন কম্পিত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন- উড়োজাহাজে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছে আমরা কাছাকাছি আশগাবাতে অবতরণ করছি’... তখন ইনফ্লাইট স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছিলো নিচে ওই কারাকুম মরুভূমি।
এর আগে রাজশাহী পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশের সীমা ছাড়িয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার পাটনা হয়ে ফ্লাইট যখন গঙ্গা পাড়ি দিচ্ছিলো তখন থেকেই ইনফ্লাইট ম্যাপে চোখ। দেখা গেলো একে একে মুজাফফর নগর, নেজাবাবাদ, দেরাদুন, হরিদ্বার, যোধপুর, দেবগ্রা, ঋষিকেশ, পানিপথ, বারনালা, লখনৌ, দিল্লি, হরিয়ানা, শরণপুর, চণ্ডিগর, লুধিয়ানা, জলান্ধর, অমৃতসর, লধকা, সাতন্দুজ, চন্দ্রভাগা দুই ধারে রেখে ভারতের অন্তত পাঁচটি অঙ্গরাজ্য পাড়ি দিলো ফ্লাইটটি। এরপর পাকিস্তানের লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি, ইসলামাবাদ, পেশওয়ার ছুঁয়ে আফগানিস্তানের জালালাবাদ, কাবুল, তাসখন্দের পথ ধরেই এগিয়ে গেলো।
এভাবে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার উড়ে গিয়ে তবেই তুর্কমেনিস্তানের এই কারাকুমের আকাশে পড়েছে রাঙাপ্রভাত। উপরের কিংবা নীচের আকাশে তখন দুপুরের তপ্ত রোদ। আরও নীচে মরুভূমির কালো বালুকারাশি। আর ঠিক তখনই এই ঘোষণা-
‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অনুগামী দলের সদস্যগণ- উড়োজাহাজে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছে আমরা কাছাকাছি আশগাবাতে অবতরণ করছি...’
পশ্চিমে কাস্পিয়ান সাগর, উত্তর অরাল সমুদ্র, পূবে আমু দরিয়া রেখে মাঝখানের এই কালো বালুকারাশির মরুভূমি সম্পর্কে যাদের ধারণা নেই তাদের জন্য জানাচ্ছি-
তিন লাখ ৫০ হাজার বর্গকিলোমিটারের এই মরুভূমিতে নেই কোনও জনবসতি। পূরো অঞ্চল জুড়ে যেই জনা কয়েকের বাস তাতে প্রতি সাড়ে ছয় বর্গকিলোমিটার ঘুরলে একজনের দেখা মিলবে। আর প্রতি বছর নাকি এই মরুতে ৭০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। তবে বালুর নিচে গ্যাস আর তেলের অফুরান মজুদ। কিন্তু সেই গ্যাস তুলতে তৈরি দেরওয়াজে গ্যাসফিল্ডে ১৯৭১ সালে ভয়াবহ বিষ্ফোরণ ঘটে। এরপর থেকে এই মরুভূমি ‘নরকের দরজা’ বলে কুখ্যাতি পেয়েছে।
ফ্লাইট উড়ে যাওয়ার কথা ছিলো কাস্পিয়ানের উপর দিয়ে। সেদিকে না গিয়ে বায়ে মোড় নিয়ে আশগাবাতের দিকে এগিয়ে গেলো। ১৫ মিনিটের মাথায় আশগাবাত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করলো বিজি-১০১১।
টানা ১৫ মিনিট বলা চলে নিস্তব্ধ হয়েছিলো ফ্লাইটের ভেতরটা। সবগুলো মানুষই যেনো শক্ত হয়ে বসেছিলেন। অবশেষে ফ্লাইটের ইঞ্জিন থামলো। সবাই যেনো প্রাণ ফিরে পেলেন ধরে। এইবার মুখে রা কাড়লো। অনেকেরই প্রথম কথাটি ছিলো এমন- ‘ভাই ভয় পেয়ে গেছি’।
ভয় পাওয়ারই কথা। ফ্লাইটের জরুরি অবতরণের দুই-একটি অভিজ্ঞতা যাদের ছিলো তারা কেউ কেউ বললেন, আসলে পাইলটের কণ্ঠটাই ছিলো ভয় পাইয়ে দেওয়ার মতো। মুখে তিনি বলেছিলেন ঠিকই ভয় নেই। কিন্তু কণ্ঠ তার সেটা বলছিলো না।
যাই হোক অবতরণ ঠিক মতোই হলো। প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে যাওয়া হলো বিমানবন্দরের লাউঞ্জে। বাদ-বাকিরা ফ্লাইটের ভেতরেই।
এবার শুরু হলো জল্পনা-কল্পনা। কী হয়েছে? কেনো হয়েছে? এসব প্রশ্ন।
প্রশ্ন সবারই। কিন্তু জানার দায়িত্ব সংবাদকর্মীদের। একটু পরপরই এ-ও জিজ্ঞেস করছেন, ভাই কিছু কি জানলেন?
বিমানের কয়েকজন কর্মকর্তা ভেতরেই ছিলেন। একজনের কাছে জানা গেলো ইঞ্জিন চালু রাখার জন্য যে তেলের লাইন। তাতে লিকেজ ধরা পড়েছে। তাই পাইলট ঝুঁকি নিতে চাননি।
বেশ! প্রাথমিক তথ্য জানা গেলো। এবার প্রশ্ন কীভাবে এই খবর ঢাকায় পৌঁছাবে। একটি রোমিং লাইন ছিলো একজন সংবাদকর্মীর কাছে। একজনের সিম-আরেকজনের ফোন সেট এই সমন্বয় করে ফোন করার ব্যবস্থা হলো ঠিকই; কিন্তু ঢাকায় কল যাচ্ছে না। যাচ্ছে লন্ডনে। অবশেষে লন্ডন ভায়া হয়েই ঢাকায় বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম এর এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেনের কাছে খবর পৌঁছানো সম্ভব হলো। ফ্লাইটের অবস্থান ট্র্যাক করা হলো। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে তবেই বাংলানিউজে প্রকাশিত হলো- প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী ফ্লাইট আশগাবাতে জরুরি অবতরণের খবর।
আর বাংলানিউজে একটি খবর প্রকাশিত হলে তা কোটি মানুষের কাছে পৌঁছাতে সময় লাগে না সে কথা সবারই জানা।
এদিকে দেশে যখন এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়াচ্ছে তখন আশগাবাত এয়ারপোর্টে আমাদের অপেক্ষার পালা। প্রাথমিকভাবে পাইলট ঘোষণা দিলেন এক ঘণ্টার মধ্যে ত্রুটি সারিয়ে বিজি-১০১১ আবার্ও উড়বে। কিন্তু সেটি হলো না।
এর মধ্যে আশগাবাতে অবতরণ করেছেন আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট। সেখানে একটি কর্মসূচিতে যোগ দেবেন বলে। ফলে সরঞ্জাম উড়োজাহাজের কাছে আনতেই লেগে গেলো সময়।
প্রায় দেড় ঘণ্টা পর হঠাৎ দেখা গেলো লাল-সবুজ লেজের একটি উড়োজাহাজ নামছে আশগাবাত বিমানবন্দরে। ওটি ছিলো বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সেরই একটি ফ্লাইট। স্বস্তি নামলো অনেকের মাঝে। যাক উদ্ধারকারী উড়োজাহাজ পৌঁছে গেছে।
জানা গেলো বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের লন্ডনগামী ফ্লাইটটি এই পথেই ছিলো, সেটির গতি পরিবর্তন করে আশগাবাত নেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর এই ট্যুর আয়োজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একজন বললেন, কি আয়রনি দেখুন... একবার কথা হচ্ছিলো ওই ফ্লাইটটিতেই প্রধানমন্ত্রী ও তার সফর সঙ্গীরা যাবেন। আগে তাদের বুদাপেস্ট নামিয়ে নিয়মিত যাত্রীরা ফের লন্ডনে যাবেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাতে রাজি হননি, বলেছিলেন- না ওই ফ্লাইটের যাত্রীদের কষ্ট হবে, সেটা ঠিক হবে না। এখন সেটিকেই উড়ে আসতে হলো তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
সময় কেটে যাচ্ছে- এর মধ্যে জানা গেলো সারাই শেষ হলে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে রাঙাপ্রভাতই হাঙ্গেরি যাবে। তবে সতর্কতা হিসেবে দ্বিতীয় ফ্লাইটটি এই বিমানবন্দরে অবস্থান করবে। ভালোয় ভালোয় রাঙাপ্রভাত উড়ে গেলে, আধাঘণ্টা অপেক্ষা করে তবেই অন্যটি আশগাবাত ছেড়ে লন্ডন যাবে।
এরপর চার ঘণ্টা পার করে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে আশগাবাত ছাড়লো আর নির্ধারিত সময়ের চার ঘণ্টা পড়ে স্থানীয় সময় রাত পৌনে এগারোটায় বুদাপেস্টের ফেরেন্স লিৎস বিমানবন্দরে নির্বিঘ্নে অবতরণ করলো রাঙাপ্রভাত।
পরে যা কিছু জানা গেলো সেই দুপুরে আসলেই এক ভয়াবহ বিপদের মুখে পড়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার অনুগামী দলে থাকা আরও দেড় শতাধিক মানুষ।
প্রধানত ইঞ্জিনের সবটুকু তেল পড়ে যাওয়ায় তা বন্ধ হয়ে যায়, ফলে একটি ইঞ্জিন বন্ধ রেখেই অবতরণ করতে হয় পাইলটকে। সেটি সমস্যা নয়, তবে সমস্যা হচ্ছে, আর কিছুক্ষণ এমনটা চললে ওই ইঞ্জিনে আগুন ধরে যেতে পারতো এখন এমটাই বলছেন কেউ কেউ।
তাছাড়া কাস্পিয়ান ছোট হলেও আর ঘণ্টা খানেক ফ্লাইটটি উড়ে গেলে তা গিয়ে পড়তো কৃষ্ণ সাগরে। সেখান থেকে জরুরি অবতরণের জন্য কাছাকাছি বিমানবন্দর পাওয়া যেতো না, ফলে সমূহ বিপদের সম্ভাবনাই ছিলো।
সবচেয়ে বড় কথা- জানা গেছে একটি নাট ঢিলা থাকার কারণেই ইঞ্চিনের তেল চুইয়ে চুইয়ে পড়ে গেছে। মানে হচ্ছে-এটি লিকেজ কিংবা আকাশে ঘটা কোনও দুর্ঘটনা ছিলো না। ছিলো স্রেফ সতর্কতার অভাব। ফ্লাইট উডডয়নের আগে সাধারণ চেকিংয়েই তা ধরা পড়তে পারতো।
কিন্তু তা না করায়, যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিলো তাতে বলা চলে, স্রেফ পরম করুণাময়ের ইচ্ছাতেই রক্ষা পেলো দেড় শতাধিক প্রাণ। বেঁচে গেলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যে কথাটি অনেকেই বলেন এভাবে- হাসিনা নয়, বলা চলে বাংলাদেশ বেঁচে গেছে। তা-না হলে কারাকুমের তপ্ত কালো বালুতেই ঘটে যেতে পারতো এক ভয়াবহ পরিণতি।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০১৬
এমএমকে