জাফলং, সিলেট থেকে: বন্ধুদের সঙ্গে সিলেটের জাফলং’এ ঘুরতে এসেছেন সাজ্জাদুল ইসলাম নামে এক তরুণ। স্থানীয় জাফলং বাজারের ক্ষুধা রেস্টুরেন্টের ঠিক পেছনের মাঠে গাড়ি থেকে নামতেই তাকে উদ্দেশ্য করে হাঁক দিলেন খুচরা এক মাদক বিক্রেতা।
ফেনসিডিলে আসক্ত ওই তরুণ পকেট থেকে দুই হাজার টাকা বের করে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে কাগজে মোড়ানো দু’টি প্লাস্টিকের বোতল তার হাতে ধরিয়ে দিয়েই চম্পট দিলেন জব্বার নামের যুবক বয়সী সেই মাদক বিক্রেতা।
ফেনসিডিল মনে করে যখন কাগজ সরালেন তখন চোখ ছানাবড়া। দেখলেন এটা তো ‘কফ সিরাপ’।
প্রতারিত হয়ে তরুণেরা হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু করলেন জব্বারকে। কিন্তু ধুরন্ধর এ যুবক ততক্ষণে গা ডাকা দিয়েছেন। পরে স্থানীয় এক পানি বিক্রেতা বললেন, ‘স্থানীয় নতুন বস্তির জব্বার প্রতিদিনই দূর দূরান্ত থেকে আসা পর্যটকদের সঙ্গে এমন অভিনব কৌশলে প্রতারণা করছেন।
ভারতীয় ব্র্যান্ডের বিভিন্ন মদের বোতলেও পানি ঢেলে মদ হিসেবে দিব্যি চালিয়ে দিচ্ছেন তিনি।
শুক্রবার (০২ ডিসেম্বর) বিকেলে এসব ঘটনা প্রবাহ চলতে থাকে বাংলানিউজের প্রতিবেদকের চোখের সামনেই। তবে তামাবিল সীমান্ত দিয়ে প্রতিনিয়তই অবৈধভাবে সিলেটে প্রবেশ করছে ভারতীয় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদ ও ফেনসিডিলের চালান।
রাখঢাক না করে প্রকাশ্যেই পর্যটকদের কাছে এসব মাদক দ্রব্য বিক্রি করছেন স্থানীয় মাদক বিক্রেতারা। সীমান্তরক্ষীদের নাকের ডগায় এসব অনৈতিক কারবার চলছে একদিন প্রতিদিন।
আবার ওই জব্বারের মতো এক শ্রেণীর প্রতারক খুচরা মাদক ব্যবসায়ীরাও অনেক সময় পর্যটকদের বোকা বানিয়ে ফেনসিডিলের নাম করে ‘কফ সিরাপ’ ও মদের বোতলে পানি ভরে বিক্রি করছেন।
স্থানীয়রা জানালেন, হাল সময়ে ফেনসিডিলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এক শ্রেণীর মাদক ব্যবসায়ীরা সস্তা ও সহজলভ্য হিসেবে কফ সিরাপকে ফেনসিডিল হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছেন।
এ কারণে এখানে দেশি-বিদেশি সিরাপের চাহিদা বেড়ে গেছে। চিকিৎসকের বিনা ব্যবস্থাপত্রেও (প্রেসক্রিপশন) এ কারবারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন স্থানীয় ওষুধের দোকানিরা।
নেশা হিসেবে কফ সিরাপের আশঙ্কাজনক বিস্তারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন চিকিৎসকরা। কফ সিরাপ সেবনের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তারা বলছেন, নিয়মিত অতিরিক্ত কফ সিরাপ সেবনকারীর মস্তিষ্ক বিকৃতি ও শ্বাস- প্রশ্বাস ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে অবশেষে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
এছাড়া প্রচণ্ড বিষন্নতা, চোখ, নাক দিয়ে পানি পড়া, চোখের মনি সংকুচিত হয়ে পড়া, চামড়া স্যাঁতস্যাঁতে ও নীলাভ হয়ে যাওয়াসহ নানাবিধ অসুখে আক্রান্ত হতে পারে।
ঘুরে দেখা গেলো, প্রতিদিন দুপুরের পরপরই পাল্টে যায় জাফলং এলাকার চিত্র। এখানে মদ, ফেনসিডিল ও গাঁজা বিক্রি হয় প্রকাশ্যে। দূর দূরান্ত থেকে মদ বা ফেনসিডিল সেবন করতে প্রতিদিনই বিপুল সংখ্যক তরুণ এখানে আসেন।
আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা খুচরা মাদক ব্যবসায়ী নিয়োগ দিয়েছেন। এরা ছদ্মবেশে মিশে যায় এখানে আসা পর্যটকদের সঙ্গে।
স্থানীয় জব্বারের মতো প্রায় জনা বিশেক তরুণ চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীদের খুচরা বিক্রেতা হিসেবে কাজ করেন।
খোঁজ নিয়ে যায়, প্রতি বোতল ফেনসিডিলে খুচরা ব্যবসায়ীরা পান ১০০ থেকে ২০০ টাকা। আর ৫০০ থেকে ৭০০ মিলিলিটারের একটি মদের বোতল থেকে এরা ২০০ টাকার মতো কমিশন পায়।
পরিচয় গোপন করে বাংলানিউজ এখানে আলাপ করে আয়নাল ও রায়হান নামের দু’খুচরা মাদক বিক্রেতার সঙ্গে। স্থানীয় জেলা পরিষদ ডাক বাংলো সংলগ্ন বাল্লাঘাট পিকনিক সেন্টারের সামনে রায়হান তখন প্রকাশ্যেই হাঁক দিয়ে হুইস্কি, এসি ব্ল্যাক, সিগনেচার, অফিসার চয়েসসহ বিভিন্ন ভারতীয় ব্র্যান্ডের মদের প্রচারণা চালাচ্ছিলেন।
বাংলানিউজকে রায়হান জানান, এখানে মাদকের হাটের অন্যতম নিয়ন্ত্রক লম্বু সেলিম ও রফিকুল। তার মতো তাদের মাদক বিক্রেতার কাজ করেন আরও প্রায় জনাবিশেক তরুণ।
স্থানীয় পিয়াইন নদের তীরে আলাপ হচ্ছিলো হোটেল ব্যবসায়ী আক্কেল আলীর সঙ্গে। গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা হলেও বেশ ক’বছর ধরে এখানেই ব্যবসা করছেন তিনি। আক্কেলের মারফত পরিচয় হলো আয়নাল নামের একজন খুচরা মাদক বিক্রেতার সঙ্গে।
আক্কেল বলেন, এখানে ৮ থেকে ১০জন মাদক বিক্রেতার একটি চক্র রয়েছে। তাদের অত্যাচারে আমরা নিজেরাও অশান্তিতে রয়েছি।
স্থানীয় সূত্র জানায়, আগে ফেনসিডিলের বাজার মূল্য যেখানে ৪ থেকে ৫০০ টাকা ছিলো এখন তা ৮০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।
নেশায় আসক্তরা এক বোতল ফেনসিডিল খেলে যে নেশা হয় মাত্র ৩০ টাকায় দু’টি কফ সিরাপ পান করলে একই নেশা পাওয়া যায়। মূলত এ সুযোগকে কাজে লাগিয়েই ধুরন্ধর মাদক বিক্রেতারা ফ্রি স্টাইলে এমন প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্ধা ও পর্যটকরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৯২২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০১৬
এমএএএম/এমএ