খুলনা: যাত্রী বেশে ছেলে-মেয়ে ব্যাগ-বস্তা নিয়ে ট্রেনে উঠেছেন তারা। সবার আগে উঠলেও সিট দখল করেননি কেউ।
মালামাল রেখে বস্তা দিয়ে বা নিজে দাঁড়িয়ে থাকেন অনেকে। যাতে বোঝা না যায় স্থানটি কাটা বা ছেঁড়া। এরা সবাই উঠেছেন বেনাপোল থেকে। সঙ্গে রাখা এসব মালামাল চোরাই পথে ভারত থেকে আসার পর সস্তা দামে কিনে এনেছেন তারা। খুলনা রেলস্টেশন থেকে চোরাকারবারিরা সকালে কমিউটার ট্রেনে করে বেনাপোল গিয়েছিলেন এসব মালামাল আনার জন্য। মাল কিনে বিকেলে আবার ফিরছেন খুলনায়। ট্রেনে বিপুল সংখক চোরাকারবারি বিনা টিকিটে ভ্রমণের ফলে সাধারণ যাত্রীরা অনেক সময় বিড়ম্বনার শিকার হন।
খুলনার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা ট্রেনটি সোমবার (২৬ ডিসেম্বর) বিকেলে যখন যশোর স্টেশন অতিক্রম করে তখনই দেখা যায় কয়েকজন গার্ড ও রেল পুলিশ যাত্রী বেশে ওইসব চোরাকারবারিদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন। ট্রেন যখন নওয়াপাড়া ও দৌলতপুর স্টেশনে পৌঁছায় তখন লুকিয়ে রাখা মালামাল বের করে ট্রেন থেকে ঝটপট নেমে পড়েন সেসব নারী পুরুষ ও শিশুরা। বস্তা হাতে নেমেই এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়লেন সবাই। খুলনা স্টেশনেও একইভাবে মাল নামানো হয়। কমিউটার ট্রেনের দুই নম্বর বগিতে গিয়ে দেখা যায়, রেলওয়ে স্টেশনের দায়িত্বে নিয়োজিত স্টেশন মাস্টার, ট্রেনের গার্ড, কর্মচারী, জিআরপি পুলিশসহ অন্য প্রতিরোধকারী সংস্থার সদস্যরা সহযোগীর ভূমিকা পালন করে ট্রেনে চোরাই পণ্য পাচারের ক্ষেত্রে। বিনিময়ে রেলওয়ে পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের লোকজন তাদের নিয়োগ করা লাইনম্যানদের মাধ্যমে চোরাকারবারিদের কাছ থেকে চাঁদা নিচ্ছেন।
বগিটিতে দুই নারী, এক যুবক ও একটি শিশু অব্যবহৃত বাথরুম, কম্পার্টমেন্ট, ভাপারের উপর, সিট কেটে ঢোকানো চোরাই মালামাল বের করলেও পুলিশ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। রেলওয়ে পুলিশ, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা যাত্রী নিরাপত্তার দিক নজরে না রেখে চোরাই পণ্যের টোকেন গণনায় ব্যস্ত।
দৌলতপুর স্টেশনে চোরাই মাল নামানোর সময় কথা হয় শিশু হাসানের সঙ্গে। সে বলে, আমি প্রতিদিন মা, নানি ও মামার সঙ্গে খুলনা থেকে বেনাপোল যাই। সেখান থেকে চিনি, জিরা, দুধ, বিস্কুট, চা ও কিশমিশ আনি। যেদিন যেটা পাই সে দিন সেটা আনি।
সে আরও বলে, ছোট বলে মামা ও আমি অব্যবহৃত বাথরুম ও কম্পার্টমেন্টের কাটা অংশ দিয়ে ভিতরে ঢুকে মালামাল রাখতে ও বের করতে পারি।
মালামাল বের করার সময় কথা হয় ৫০ ঊর্ধ্ব দুই নারীর সঙ্গে। তারা বলেন, টাকা দিয়ে কিনে ব্যবসা করি। তারপরও মাঝেমধ্যে বিজিবি মালামাল আটক করে। আটক না করলে ভালোই লাভ হয়। আর আটক করলে কিছুই থাকে না। একদিন বাদশা তো আরেক দিন ফকির।
মালামাল কিনতে চাইলে তারা বলেন, এসব মালামাল খুচরা বিক্রি করা হয় না। নির্দিষ্ট দোকানেই দেওয়া হয়।
খুলনা-বেনাপোল রেলপথের নিয়মিত যাত্রী আব্দুল্লাহ জানান, যাত্রীবাহী লোকাল এ ট্রেনে অবাধে আসছে ভারতীয় পণ্য ও মাদকদ্রব্য। রেল পুলিশকে ঘুষ দিয়ে চোরাকারবারিরা এসব পণ্য পরিবহন করছে। চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্যে যাত্রীরা অসহায়।
তিনি অভিযোগ করেন, খুলনা-যশোর বেনাপোল রুটে চলাচলকারী কমিউটার ট্রেন পরিণত হয়েছে চোরাচালানিদের নিরাপদ রুটে। আর এর সঙ্গে জড়িত ট্রেনের কিছু অসাধু কর্মচারী ও রেলওয়ে পুলিশ।
রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনীর এক কমকর্তা জানান, বেনাপোল থেকে খুলনা রুটে কমিউটার নামে একটি লোকাল ট্রেন চলে। ট্রেনটি সকালে খুলনা স্টেশন থেকে বেনাপোলে যায় আর বিকেলে সেখান থেকে খুলনায় আসে। ট্রেনটি মাঝে বেনাপোল থেকে যশোর পর্যন্ত এসে আবার বেনাপোল যায়।
তিনি জানান, চিত্রা, সুন্দরবন, সীমান্ত ট্রেনের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত সব বগিতে যাওয়া গেলেও কমিউটার ট্রেনে যাওয়া যায় না। যে কারণে কম্পার্টমেন্ট, সিট ও অব্যবহৃত বাথরুম কেটে চোরাকারবারিরা তাদের মালামাল রাখতে পারে।
খুলনা রেল পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর ও ভারপ্রাপ্ত ওসি অসীম বাংলানিউজকে বলেন, চেক করেই মালামাল ওঠানো হয়। তারপরও মাঝে মধ্যে চোকাবারবারিরা মালামাল আনা-নেওয়া করে। এসব মালামাল আটক করা হয়। দেওয়া হয় তাদের বিরুদ্ধে মামলাও।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৬
এমআরএম/এএ