অভিযোগ রয়েছে কোনও কোনও কূটনীতিক শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি ও কাস্টমস পাসবুকের অপব্যবহার করে স্বর্ণ চোরাচালান, গাড়ির ব্যবসাসহ অন্যান্য অপরাধে জড়িত।
এ ধরনের অপব্যবহার রোধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
কূটনৈতিক সুবিধার অপব্যবহার করায় এরইমধ্যে কয়েকজন কূটনীতিককে বহিষ্কার করা হয়েছে। কয়েকটি দেশের কূটনীতিককে নজরদারিতে রেখেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর।
সর্বশেষ গত ৯ জানুয়ারি চোরাচালানের অভিযোগে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কৃত উত্তর কোরিয়ার কূটনৈতিক হ্যান সন ইক এর মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা বিলাসবহুল রোলস রয়েস (ঘোস্ট মডেল) গাড়িটি জব্দ করা হয়।
কমলাপুর আইসিডিতে কন্টেইনার থেকে গাড়িটি জব্দ করে শুল্ক গোয়েন্দা। গত ৮ আগস্ট হ্যান সন ইককে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি উত্তর কোরিয়া দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি ও হেড অব চ্যান্সেরি হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
সূত্র জানায়, মার্চ মাসে হ্যান সন ইক ২০১৪ মডেলের বিএমডব্লিউ এক্স-৬ মডেলের গাড়ি আমদানির ঘোষণা দেন। আমদানির পর গাড়িটি ছাড়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। বিএমডব্লিউ হিসেবে গাড়িটি ছাড়ে অনাপত্তিপত্র দেওয়া হয়।
বিষয়টি শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের সন্দেহে পড়লে তাতে উদ্বিগ্ন হয়ে ওই কূটনীতিক গাড়িটি ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করেন।
এ পর্যায়ে কন্টেইনারটি খালাস না করতে ২২ আগস্ট শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ সংশ্লিষ্ট দফতর গুলোকে নোটিশ দেয়।
দীর্ঘ ৭ মাস পর্যবেক্ষণের পর ৯ জানুয়ারি কন্টেইনার খুলে বিএমডব্লিউ এক্স-৬ এর পরিবর্তে ২০১৫ মডেলের ৬৬০০ সিসির রোলস রয়েস ঘোস্ট গাড়িটি পাওয়া যায়। যা সাথে সাথে জব্দ করে শুল্ক বিভাগ।
২২ কোটি টাকা শুল্ককরসহ গাড়িটির মূল্য প্রায় ৩০ কোটি টাকা।
সূত্র আরো জানায়, হ্যান সন ইক ১৪ জুলাই কূটনৈতিক সুবিধায় খাদ্য পণ্যের ঘোষণা দিয়ে একটি কন্টেইনার আমদানি করেন। সন্দেহ হলে শুল্ক গোয়েন্দারা কন্টেইনারটি নজরদারিতে রাখেন।
পরে ২ আগস্ট পরীক্ষা করে কন্টেইনারে খাদ্য পণ্যের পরিবর্তে ৮ হাজার ৯৯ কার্টন সিগারেট, এলইডি টিভি, এসিসহ ইলেকট্রনিক্স পণ্য পাওয়া যায়। যার আনুমানিক মূল্য সাড়ে ৩ কোটি টাকা। ৩ আগস্ট কূটনৈতিক সুবিধার অপব্যবহার করার দায়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। পরে সরকার তাকে বহিষ্কার করে।
সূত্র জানায়, ৭ মার্চ ঢাকায় উত্তর কোরিয়ার ফার্স্ট সেক্রেটারি (বাণিজ্য ও অর্থনীতি) সন ইয়াংকে ১৩ কোটি টাকা মূল্যের ২৭ কেজি স্বর্ণসহ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটক করা হয়।
পরে ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী মুচলেকা দিয়ে কূটনীতিককে ছাড়িয়ে নেওয়া হলেও পরে এ কূটনৈতিককে বহিষ্কার করে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
২০১২ সালে কমলাপুর আইসিডি দিয়ে কোরিয়া দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি পাক টং চ্যানের আমদানি করা চালানে ঘোষণা বহির্ভূত প্রায় দেড় কোটি টাকার পণ্য জব্দ করা হয়। পরে তাকে বহিষ্কার করে সরকার।
এনবিআরের সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী, গত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কাজ করা প্রায় ২৫টি সংস্থার ৩৯৫ জন বিদেশি নাগরিক শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানি করেন।
এর মধ্যে বেশিরভাগ কর্মকর্তা ইউএনডিপির। এছাড়া বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা ডিএফআইডি, ইউএসএআইডি, ইউনিসেফ’র কর্মকর্তাও রয়েছেন। তাদের অনেকেই ফেরত না নিয়ে এসব গাড়ি বিক্রি করে গেছেন। এতে সরকার বিপুল অংকের রাজস্ব হারিয়েছে।
২৮ নভেম্বর উত্তরা থেকে ইউএনডিপির সাবেক আবাসিক প্রতিনিধি স্টিফান প্রিজনারের ব্যবহৃত মিতসুবিসি পাজারো জব্দ করা হয়। প্রিজনার তার গাড়িটি ইউএনডিপির একজন বাংলাদেশি স্টাফের কাছে বিক্রি করে যান।
২২ ডিসেম্বরের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সিনিয়র স্কিল ডেভেলপমেন্ট স্পেশালিস্ট কিশোর কুমার সিং এর ব্যবহৃত হলুদ নম্বরপ্লেটের একটি গাড়ি জব্দ করা হয়। ১৯ ডিসেম্বর গাড়ি জমা দিতে চিঠি দেওয়া হয়।
১ জানুয়ারি গুলশান থেকে আইএলও’র সাবেক কর্মকর্তা নিসকে জ্যানসেন এর ব্যবহৃত পাজারো জিপ জব্দ করা হয়। এ কর্মকর্তা সম্প্রতি কম্বোডিয়ায় বদলি হয়ে গেছেন। কিন্তু গাড়ি ও কাস্টমস পাসবুক জমা দেননি।
সূত্র জানায়, ৩৯৫টি গাড়ি খুঁজে বের করা ও ৩১ জানুয়ারির মধ্যে পাসবুক ফেরত দিতে উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেবে এনবিআর। এর মধ্যে অনেক গাড়ি নজরদারিতে রেখেছে শুল্ক গোয়েন্দা।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বাংলানিউজকে বলেন, কূটনৈতিক সুবিধার অপব্যবহার করা গাড়ি নজরদারিতে রয়েছে। শিগগিরই অনেক গাড়ি জব্দ হবে।
তিনি বলেন, কূটনৈতিকদের শুল্কমুক্ত সুবিধার অপব্যবহার করা উদ্বেগজনক। গাড়ির পাশাপাশি কন্টেইনার নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। কিছু তথ্য পাওয়া গেছে, যাচাই শেষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কূটনৈতিক সুবিধার অপব্যবহার করায় উদ্বেগ জানিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, পাসবুক জমা ছাড়া কোনো কূটনৈতিক দেশ ত্যাগ করতে পারবেন না। অনেকদিন ধরে কিছু দেশের কূটনীতিকরা এর অপব্যবহার করছেন।
তিনি বলেন, শুল্ক গোয়েন্দা ইতোমধ্যে নজরদারি বাড়িয়েছে। এতে কিছু ফলাফলও পাওয়া গেছে। আমরা তথ্য যাচাই করছি। ভবিষ্যতে আরো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৭
আরইউ/জেডএস