হাজার ছাড়া যেন কোনো কথাই নেই। কোনোটিতো অর্ধ লাখ টাকা দাম হাঁকাচ্ছেন ফজলু মিয়া।
ক্রেতা দাম না বলে পাশের জনের সঙ্গে কানে কানে শলা-পরামর্শ করলেন। কোরবানির হাটে যেভাবে বেশ কয়েকজন মিলে যান গরু কিনতে। দাম করার আগে শলা-পরামর্শ করেন। এখানেও তেমন দৃশ্য দেখা গেলো। একেকটি গ্রুপে পাঁচজন সাতজন করে মেলায় প্রবেশ করছেন।
গ্রুপ হবে না কেন, কোরবানির পশুর চেয়ে কোন অংশে ছোট বলবেন এ মাছগুলোকে। কোরবানিতে যেমন একেকটি গরুর দাম লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এখানেও তো কখনও কখনও একটি মাছের দাম লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। অনেকে দলবেধে এসে মাছ কিনে বাসায় গিয়ে ভাগবাটোয়ারা করে নেন।
ফজলু মিয়া পনের বছর বয়স থেকে এ মেলায় আসেন দোকান নিয়ে। তারা ছয়জন মিলে নয় লাখ টাকার মাছ কিনে এনেছেন। প্রথম দিনে দেড় লাখ টাকার মাছ বিক্রি করেছেন। আশা করছেন দ্বিতীয় দিন ও রাতের মধ্যেই সব বিক্রি হয়ে যাবে।
তার মতো কয়েকশ’ বিক্রেতা অংশ নিয়েছেন শেরপুরের মাছের মেলায়। তবে অনেকে দেশীয় নানা প্রজাতির ছোট মাছও নিয়ে এসেছেন। বেচাকেনাও চলছে ধুমছে। প্রত্যেকটি দোকানের সামনে জটলা। কেউ কেউতো সেলফি তুলতেও ব্যস্ত।
বলছিলাম মৌলভীবাজারের শেরপুরের ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলার কথা। দুই দিনব্যাপী এ মেলায় আট থেকে নয় কোটি টাকার মাছ বেচাকেনা হবে বলে আশা করছেন মেলা কমিটির লোকজন।
কারো কারো মতে শতবর্ষী হয়ে গেছে এ মাছের মেলা। আগে মনু নদীর মুখে বসতো এ মেলা। মনু মুখ ভাঙনের কারণে সরিয়ে নেওয়া হয় হামরকোনায়। সেই জায়গাটিও ভাঙনের কবলে পড়লে দীর্ঘদিন ধরে কুশিয়ারা নদীর তীর ঘেঁষে বসছে এ উৎসব।
পৌষ সংক্রান্তী উপলক্ষে এ মেলা মূলত পৌষ মাসের শেষ দুই দিন ও দুই রাতে চলে বেচাকেনা। সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত থাকে বেশি জমজমাট।
ব্রাহ্মণগাঁও’র মাছ বিক্রেতা ফজলু মিয়া জানান, কুশিয়ারা, মনুসহ বিভিন্ন নদী ও হাওর থেকে মাছ আসে এখানে। এ মেলাকে লক্ষ্য করে চলে মাছ ধরারও উৎসব। তিনি বলেন, কুশিয়ারা নদীতে কাঁটা (গাছের ডাল, বাঁশ-ঝাড়) ফেলে রাখা হয়। সেখানে এসে মাছ আশ্রয় নেয়। মেলার ঠিক দুই দিন আগে জাল দিয়ে ঘিরে মাছ ধরা হয়। সেই মাছ তারা কিনে বিক্রি করতে আনেন।
প্রায় তেইশ বছর ধরে প্রতি বছর এ মেলায় মাছ বিক্রি করতে আসেন বলে জানান তিনি।
মাছের মেলাটি সিলেটের কুশিয়ারা, সুরমা, মনু নদী, হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, কাছাড়িয়া হাওরসহ বিভিন্ন বিল ও নদীর মাছের ওপর ভিত্তি করেই এক সময় গড়ে উঠেছিল। কিন্তু এখন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে মাছ নিয়ে আসেন ব্যবসায়ীরা।
এবারের মেলা রেকর্ড ভাংতে কিংবা ছুঁতে কোনোটাই পারেনি। তবে চোখ জুড়িয়ে দিয়েছে নতুন প্রজন্মের। কেউ কেউতো দরদাম শুনে হা করে তাকিয়ে থাকছেন বিস্ময়ভরা চোখে। তবে কয়েক বছর আগেও যারা ঘুরে গেছেন এ মেলা তারা কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারছেন না।
তাদের মন্তব্য, আগে দেখেছি সব তরতাজা মাছে ঠাসা। এখনতো বেশিরভাগ মাছ বরফ দিয়ে রাখা। কতগুলোতো বক্সে থাকতে থাকতে বেঁকে গেছে। দেখেই অনুমান করা যায় এই মাছগুলো দূর থেকে আনা হয়েছে।
মেলায় রুই, কাতলা, বোয়াল, গজার, আইড়, বাঘাইড়, শোল, দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছের মধ্যে চিংড়ি, পাবদা, টেংরা, শিং, মাগুর, বাইম, মলা, পুঁটি মাছের অধিক্য দেখা গেছে।
মাছের মেলা নাম হলেও বিশাল এলাকাজুড়ে ফার্নিচার, একদিকে সবজি, মাছ ধরার সরঞ্জাম, মন্ডা-মিঠাইয়ের পসরা দেখা গেছে। রয়েছে যাত্রা গানেরও আসরও। এক কোনে নাদরদোলাও ঘুরপাক খাচ্ছে হরদম।
এক সময় এ মেলাকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে উঠতো এ অঞ্চলের লোকজন। মেয়েরা এ সময়ে বাবার বাড়িতে নাইওর আসতো। এখনও পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি সেই ঐতিহ্য। তবে কিছুটা ভাটার টান ধরেছে বলে অভিমত স্থানীয়দের।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১৭
এসআই/জেডএস