নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পরপরই র্যাবের গোয়েন্দা শাখার অনানুষ্ঠানিক তদন্তে উঠে আসা চাঞ্চল্যকর তথ্যানুযায়ী, র্যাব-১১’র সাবেক এ তিন কর্মকর্তা নিরপরাধ লোকজনকে ধরে এনে মুক্তিপণের নামে বাণিজ্য করেছেন। লোকজনকে দিনের পর দিন আটকে রেখে ‘ক্রসফায়ারের’ ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিতেন।
আবার কাঙ্ক্ষিত অর্থ না পেলে ডাকাত বা সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে কাউকে কাউকে কথিত ‘এনকাউন্টারে’ দেওয়া হয়েছে। শুধু সরকারবিরোধী লোকজন নয়, তাদের নির্যাতন থেকে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতারাও রেহাই পাননি।
সাবেক র্যাব কর্মকর্তা তারেক সাঈদের নেতৃত্বে ব্যাটালিয়নে কর্মরত র্যাবের বেশির ভাগ কর্মকর্তা অস্ত্র, যানবাহন ও ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করেছেন। সরকারের প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর জামাতা হওয়ায় তারেক সাঈদ কাউকে পরোয়া করতেন না।
র্যাবের এ তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে ইতিমধ্যে পুলিশ সদর দপ্তরকে জানানো হয়েছে বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গুমের ঘটনাগুলোর ব্যাপারে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমনকি জড়িতদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলাও হতে পারে।
সাত খুনের মামলার রায়ের পর র্যাব সদর দপ্তর থেকে বুধবার (১৯ জানুয়ারি) র্যাবের প্রতিটি ব্যাটালিয়নে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে। তাতে কোনো র্যাব সদস্যের বিরুদ্ধে অপরাধে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি প্রয়োজনে ফৌজদারি আইনেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে র্যাবের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ শর্তে বলেন, ‘সাত খুনের পর র্যাবের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। তারপর এ ঘটনার রেশ কাটাতে আমরা নানাভাবে চেষ্টা করি। র্যাব-১১’র সাবেক ওই তিন কর্মকর্তা বেপরোয়া ছিলেন। কিন্তু কয়েকজন প্রভাবশালী তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ায় আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারিনি। সাত খুন মামলার রায়ের পর র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি বৈঠক হয়েছে। বৈঠক থেকে র্যাবের প্রতিটি ব্যাটালিয়নে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। র্যাবের প্রত্যেক সদস্যকে বলা হয়েছে, অপরাধ করলে তারেক সাঈদদের মতো একই পরিণতি ভোগ করতে হবে’।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনার পর র্যাব-১১’র তৎকালীন অধিনায়ক লে. কর্নেল (বরখাস্ত) তারেক সাঈদ, মেজর (বরখাস্ত) আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার (বরখাস্ত) এম এম রানাসহ ২৫ সদস্যর নাম উঠে আসার পর দেশ-বিদেশে তোলপাড় শুরু হয়। র্যাবের ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে। পরে র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে গোয়েন্দা শাখা তদন্তে নামে। বিশেষ করে তারেক সাঈদ, আরিফ হোসেন ও এম এম রানা দায়িত্ব পালনের সময় কী ধরনের অপরাধকর্ম চালিয়েছেন তা নিয়ে বিশদ তদন্ত শুরু হয়। র্যাবের এ তদন্ত চলে সাত মাস ধরে। তদন্তে ওই তিন কর্মকর্তার নানা অপকর্মের তথ্য পাওয়া যায়।
তদন্তে জানা যায়, তারা নিরপরাধ লোকজন ধরে র্যাব অফিসে এনে নির্যাতন চালিয়ে অর্থ আদায় করতেন। যারা নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের গুম করা হয়েছে। এভাবে অন্তত ২০ জনকে তারা গুম করেছেন বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
র্যাব-১১’র আওতায় থাকা নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, মুন্সীগঞ্জ, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, নরসিংদী ও ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ ও দোহার এলাকায় এসব ঘটনা ঘটেছে।
গত বছরের শেষ দিকে প্রতিবেদনটি পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক র্যাবের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। ওই কর্মকর্তার ভাষ্য মতে, তারেক সাঈদের নেতৃত্বে ব্যাটালিয়নে কর্মরত র্যাবের বেশির ভাগ কর্মকর্তা অস্ত্র, যানবাহন ও ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করেছেন। ব্যক্তিস্বার্থে তারা অনেক সময় নিরপরাধ লোকজনকেও ধরে আনতেন। তাদের নির্যাতন ছাড়াও গুম-খুনের মতো পথ বেছে নিতেন। কাউকে দিনের পর দিন আটকে রাখা হতো। ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করা হতো।
আরিফ হোসেন ও এম এম রানা যে দু’টি ক্রাইম প্রিভেনশন ক্যাম্পের (সিপিসি) অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সেখানেও নিরপরাধ লোকজনকে এনে নির্যাতন করা হতো। এক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, তারেক সাঈদ এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর আত্মীয় হওয়ায় তার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দও করা যেতো না। আর রানা ও আরিফের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের যোগাযোগ ছিলো। তারেক সাঈদ তাদের পুরোপুরি সার্পোট দিতেন।
সূত্র জানায়, র্যাবের গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সিদ্ধিরগঞ্জে বালু ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেনকে গুম করেন র্যাব-১১’র সদস্যরা। তার পরিবার নিশ্চিত হয়, তারেক সাঈদ, আরিফ ও রানার যোগসাজশে ইসমাইলকে অপহরণ করা হয়। মুক্তির জন্য ১০ লাখ টাকাও দাবি করা হয়েছিল। টাকা দিতে না পারায় ইসমাইলকে আর ফেরত পায়নি তার পরিবার। পরে ইসমাইলের ছোট ভাই আবদুল মান্নান বাদী হয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় মামলা করেন।
এজাহারে বলা হয়, নূর হোসেনের সঙ্গে ইসমাইলের ব্যবসায়িক বিরোধ ছিল। তারই জের ধরে র্যাবকে দিয়ে ইসমাইলকে অপহরণ করায় নূর হোসেন। সাত খুনের পর দেশে ফিরিয়ে আনার পর জিজ্ঞাসাবাদে নূর হোসেনও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানিয়েছেন, র্যাবের সাবেক ওই তিন কর্মকর্তাকে মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়ার পর ইসমাইলকে অপহরণ করা হয়। ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুর থেকে র্যাব পরিচয়ে অপহরণ করা হয় সাহাব উদ্দিন সাবু নামে বিএনপির এক নেতাকে। তিনি বেঁচে আছেন নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে, তা আজও জানতে পারেনি পরিবার। র্যাবের গোয়েন্দা শাখা তদন্ত করে নিশ্চিত হয় যে সাবুর গুমের পেছনে তারেক, আরিফ ও রানা জড়িত।
র্যাবের ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ২৯ মার্চ কুমিল্লার যুবলীগ নেতা রকিবুল হাসান শাওন অপহৃত হন। তার পরিবার জানতে পারে, র্যাব-১১-র কার্যালয়ে আছেন শাওন। তাকে মুক্ত করতে পরিবারের সদস্যরা তারেক সাঈদের সঙ্গে দেখা করেন। শাওনকে ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে পরিবারের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে বলে র্যাবের তদন্ত কর্মকর্তারা নিশ্চিত হয়েছেন।
শাওনকে ফিরে না পেয়ে পরে তার মা আনোয়ারা বেগম বাদী হয়ে আদালতে মামলা করেন। মামলায় সরাসরি ১৫ জন র্যাব সদস্যের নাম উল্লেখ করা হয়। মামলা তদন্ত করে কুমিল্লা জেলার ডিবি পুলিশ। তবে ডিবি পুলিশের তদন্তে বলা হয়, শাওনের নিখোঁজের ব্যাপারে র্যাবের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে শাওনের মা আদালতে নারাজি পিটিশন দাখিল করেন। তবে র্যাবের গোয়েন্দা শাখা নিশ্চিত হয় মোটা অঙ্কের টাকার লোভেই তারেক সাঈদ, আরিফ ও রানা তাকে গুম করে ফেলেছেন।
২০১৪ সালের ১৯ এপ্রিল নোয়াখালীর যুবলীগ নেতা মোসলেহ উদ্দিন দাউদকান্দি থেকে নিখোঁজ হন। এ ঘটনার সঙ্গেও র্যাবের ওই তিন কর্মকর্তা জড়িত। ২০১৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সোনারগাঁ এলাকা থেকে নিখোঁজ হন ব্যবসায়ী তাজুল ইসলাম। তার পরিবারও জানতে পারে, র্যাব-১১-র সদস্যরা তাকে অপহরণ করে গুম করেছে। নিখোঁজ হওয়ার ১৩ তিন পর মেঘনা নদীতে তাজুলের পেট কাটা মরদেহ ভেসে ওঠে। ওই বছরের ১৯ ডিসেম্বর তাজুলের পরিবার সোনারগাঁ থানায় মামলা করে। ২০১৩ সালের মাঝামাঝি নারায়ণগঞ্জ থেকে নিখোঁজ হন কালাম শিকদার নামের এক যুবক। আজও তার সন্ধান পায়নি পরিবার।
২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর লাকসাম থেকে কুমিল্লা যাওয়ার পথে লাকসামের বিএনপি নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম হিরু ও হুমায়ুন কবির পারভেজ অপহৃত হন। পরিবারের অভিযোগ, তারেক, আরিফ ও রানার নেতৃত্বই তাদের অপহরণের পর গুম করা হয়েছে। র্যাবের তদন্ত প্রতিবেদনেও তা নিশ্চিত হওয়া গেছে। অপহৃত ব্যক্তিদের স্বজনরা এ ঘটনায় আদালতে তারেক সাঈদকে ১ নম্বর আসামি করে মামলা করেন।
র্যাবের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর তারেক সাঈদসহ র্যাব-১১-র সদস্যদের বিরুদ্ধে লক্ষ্মীপুরে জামায়াত নেতা ডাক্তার ফয়েজ আহম্মেদকে বাড়ির ছাদে নিয়ে গুলি করে হত্যার অভিযোগ ওঠে। ২০১৪ সালের ৩ ও ৫ এপ্রিল ডাকাত সন্দেহে শাহদাত হোসেন জাসু, জাবেদ ও সুমন নামের তিন যুবককে এনকাউন্টারে হত্যা করা হয়। ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে কাঁচপুর থেকে নিখোঁজ হন পরিবহন ব্যবসায়ী রোস্তম আলী। তার সঙ্গে নূর হোসেনের বিরোধ ছিল। নূর হোসেন র্যাবের সাবেক ওই তিন কর্মকর্তা দিয়ে তাকে গুম করান।
এসব অভিযোগ ও র্যাবের প্রতিবেদন প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘তারেক সাঈদ, আরিফ ও রানা অনেক অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। র্যাব সদর দপ্তরের নিজস্ব অনুসন্ধান ও তদন্তেও তা উদঘাটিত হয়েছে। র্যাবের ওই প্রতিবেদন সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল। গুমের ঘটনাগুলোর ব্যাপারে আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবো। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলাও হতে পারে। তবে র্যাব নিয়ে কারো আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। জনগণের নিরাপত্তার জন্যই র্যাব তার অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে। ’
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৭
জেডএস