ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

গার্মেন্ট মালিকদের ‘বেগম পাড়া’ টরন্টোয়!

বিজনেস ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৭
গার্মেন্ট মালিকদের ‘বেগম পাড়া’ টরন্টোয়! বিজিএমইএ ভবন

ঢাকা: হঠাৎ হঠাৎই অস্থির হয়ে ওঠে তৈরি পোশাকশিল্প পাড়া। হয় বেতন বাড়ানোর, নয়তো বকেয়া পরিশোধের দাবি। এরপর  কিছু লোক দেখানো নেগোসিয়েশন। শ্রকিক নেতা ও মালিকপক্ষের সমঝোতায় অস্থিরতা কমে। শ্রমিক আবার কাজে যায়।

আর অবধারিতভাবে  অস্থিরতাতে ঘিরে ছাঁটাই হন সেই শ্রমিকেরা যারা তাদের বকেয়া চেয়েছেন কিংবা মজুরি বাড়ানোর দাবি তুলেছেন। যেনো দাবি করাটাই সবচেয়ে বড় অপরাধ।

 

এই হচ্ছে শ্রমিকের জীবন। আর মালিকের!

তাদের দেশেই চলে বিলাসী জীবন। কিন্তু তাতে যেনো মন ভরে না। ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ায়ও তাদের চাই সমান শান-শওকাত। ঢাকার আয়ের টাকা তারা ডলার-পাউন্ড-ইউরোতে পাল্টে নিয়ে নিউইয়র্ক, টরন্টো, লন্ডন, প্যারিস, সিডনিতে ব্যবসা গড়েন। আবাস গাড়েন।

আরেকদল, তাদের এত টাকা যে ঢাকা-টরন্টো দুইই চালিয়ে যান। তার জন্য নিতে হয় বিকল্প ব্যবস্থা।

কেনো ব্যবসায়ীদের বেগমরা আছেন না! তারাও তখন হয়ে ওঠেন বড় নির্বাহী।

সম্প্রতি কানাডীয় একটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা টরোন্টোতে গড়ে তুলেছেন ‘বেগমপাড়া’। সাহেবরা থাকেন বাংলাদেশে, আর বেগমরা টরেন্টোর ‘বেগমপাড়ায়’।

কাছের দেশ মালয়েশিয়াকে ব্যবসায়ীদের সেকেন্ড হোম হিসেবে বেছে নেওয়ার কথা আগে থেকেই শোনা যাচ্ছিলো। তবে এটা এখন নতুন কনসেপ্ট। বেগমদের পাঠিয়ে দেওয়া। আর পাঠাবেনই যখন তখন আর কাছেধারে কেনো। সোজা পৃথিবীর উল্টোপাশে। সেখানে ছেলে-মেয়েরা বেশি সুবিধা পাবে। বেগমরা আয়েশি জীবন কাটাবেন।

বাংলাদেশ থেকে চাইলেও বৈধ পথে বিদেশে টাকা নেওয়া যায় না। তাতে কি? অবৈধ পথ রয়েছে না।

কানাডীয় পত্রিকাটি বলেছে, ওই বিলাসি জীবন ও নতুন নতুন ব্যবসার সব অর্থ বাংলাদেশ দেশ থেকে যাচ্ছে পাচার হয়ে।

রিপোর্টে একটা গভীর সমীকরণ তুলে ধরা হয়েছে। নিজেদের দরিদ্র দেখিয়ে আর প্রধান রপ্তানিপণ্য বলে সরকারের দেওয়া সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বন্ড সুবিধায় এই মালিকরা মালামাল আসছেন। আর সেগুলো থেকেই উপার্জিত অর্থ তারা বিদেশে পাচার করছেন অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে।
এভাবে দেশের বাইরে পোশাক শিল্প মালিকরা তাদের কর্মপরিধি বাড়িয়ে দেশে তাদের কারখানাগুলোতে কর্মপরিবেশ থাকছে কি থাকছে না, সেদিকে কোনো মনোযোগ দিচ্ছেন না। পরিবেশবান্ধব কারখানা হাতেগোনা কয়েকটি।

এখানকার শ্রমিকদের আন্দোলন সংগ্রামে মালিকদের থোরাই কেয়ার। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে দিনের পর দিন আন্দোলন চললেও এর কোনো সুরাহা হয় না। যারা প্রতিবাদ করেন উল্টো তাদেরকেই কুচক্রী বলে চাকরিচ্যুতিসহ  নানা রকম সমস্যায় ফেলা হয়। এমনকি জুলুম-নির্যাতন এবং জেল পর্যন্ত খাটতে হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন রকম সুবিধা কাজে লাগিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে দামি গাড়ির ব্র্যান্ড বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ বেঞ্জ গার্মেন্ট মালিকরা কিনছেন হরহামেশাই। যেখানে শ্রমিকদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় সেখানে এমন সুনির্দিষ্ট তথ্যও রয়েছে যে, বিজিএমইএর একজন সাবেক সভাপতির বাসায় খাওয়ার পানি যায় সোনারগাঁও হোটেল থেকে! বিজিএমইএ ভবনে বসে সংগঠনটির নেতারা প্রতিদিন দুপুরে যে খাবার খান, তাও যায় পাশের সোনারগাঁও হোটেল থেকেই।

আগুনে পুড়ে যে তাজরীন গার্মেন্টসের শতাধিক শ্রমিক নিহত হয়েছিল সেই মালিকও অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। সেখানে রয়েছে তার বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

দায়িত্বশীল সূত্রে জানা আরও কিছু  তথ্য: একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ীর চার সদস্যের পরিবারে বিএমডব্লিউসহ মোট গাড়ি রয়েছে সাতটি। আরেক ব্যবসায়ী যিনি বিজিএমইএর নেতা ছিলেন, তার ড্রয়িং রুমে রয়েছে আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যালারি। অন্য একজন গার্মেন্ট ব্যবসায়ীর গুলশানের বিলাসবহুল বাসায় রয়েছে টেনিস কোর্ট ও সুইমিং পুল। পুলিশের এক সাবেক কর্মকর্তা যিনি বর্তমানে একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের কর্ণধার ও গার্মেন্ট ব্যবসায়ী তার সিঙ্গাপুরে বাড়ি নির্মাণাধীন। ওই গ্রুপের তিনটি গার্মেন্টসের প্রায় তিন হাজার শ্রমিক তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে বিক্ষোভ করেছে অসংখ্য বার।

শ্রমিকরা যখন তাদের নায্য পাওনা দাবি করে রাস্তায় নামেন, তখন একে বলা হয় ‘ষড়যন্ত্র’,। মালিক পক্ষের একটাই কথা- গার্মেন্টস শিল্পের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে।

ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে- গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়েছে ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪২০ কোটি টাকারও বেশি। লেস ডেভেলপড কান্ট্রিস (এলডিসি) বা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ থেকেই সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

সম্প্রতি ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমেরিকা, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান ইত্যাদি উন্নত ধনী দেশসহ ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ভোগ করছে। তাদের অনুসন্ধানীমূলক ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রফতানি খাতে আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি। আয়ের ৮০ শতাংশ বিভিন্ন উপায়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। কম দামে যন্ত্রপাতিসহ উৎপাদন সামগ্রী কিনে বেশি দাম দেখিয়ে হরহামেশাই অর্থ পাচার করা হচ্ছে। পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্টরা এরূপ পাচারের সঙ্গে বেশি জড়িত।

এ খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারের কাছ থেকে ছলচাতুরির মাধ্যমে নেওয়া বিভিন্ন সুবিধার অপব্যহারকারী পোশাকশিল্প মালিকরা এখন অর্থ পাচারের শীর্ষে। তাদের এই অবৈধ কারবার চলছে বন্ডেড ওয়্যার হাউস বা বন্ড সুবিধার আড়ালে। বন্ড সুবিধায় আমদানি করা শুল্কমুক্ত কাপড় খোলাবাজারে বিক্রির ফলে ধ্বংসের মুখে পড়েছে টেক্সটাইল শিল্প। অনেকের পোশাক কারখানা না থাকার পরও বন্ড লাইসেন্স নিয়ে আমদানি করা পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করে রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন। এমন তথ্য মিলেছে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটে।

ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের সর্বশেষ তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, বাস্তবে কোনো ধরনের পোশাক কারখানা না থাকার পরও ৪৭৯টি প্রতিষ্ঠানের নামে আছে বন্ড লাইসেন্স। এসব বন্ড লাইসেন্স ব্যবহার করে পণ্য আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করেছেন কালোবাজারের সঙ্গে জড়িত পোশাক শিল্প মালিকরা। তাদের বিরুদ্ধে অনেক সময় ব্যবস্থাও নিচ্ছে কাস্টমস।

জানা গেছে, বন্ড সুবিধার অপব্যবহারকারী ১৩৩টি পোশাক কারাখানা এবং এর ৪৪৬ পরিচালকের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। দেশে এখন মোট ৬ হাজার ৫২৯ প্রতিষ্ঠানের নামে বন্ড লাইসেন্স থাকলেও, অনিয়মের কারণে ১ হাজার ৭৬০ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করেছে কাস্টমস। আবার কারখানা বন্ধ থাকার পরও বন্ড লাইসেন্স আছে ২৪৩৭টি পোশাক ও প্যাকেজিং কারখানার। এতো অনিয়মের পরও চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে বিভিন্ন ধরনের কর ও অন্যান্য সুবিধা প্রদানের পাশাপাশি পোশাক মালিকদের সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়েছে সরকার।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বন্ডের অপব্যবহার আমাদের জন্য ক্ষতিকর। এটা বন্ধ করতে চাই। এজন্য প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ নিচ্ছি। এ ছাড়াও বন্ডকে অটোমেশনের আওতায় আনা হচ্ছে।

জানা গেছে, শুল্কমুক্ত সুবিধার আড়ালে বন্ডেড ওয়্যার হাউসে অনিয়মের শেষ নেই। পুনঃরফতানির শর্তে আমদানি করা কাপড় ও কাগজসহ অন্যান্য পণ্য ফ্রি-স্টাইলে বিক্রি হচ্ছে খোলাবাজারে। বিক্রি করছে পোশাক শিল্প মালিকরা। এ সুবিধায় সরকার প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা শুল্ক অব্যাহতি দিলেও, সেই শুল্কের টাকা লুটপাটে ব্যস্ত অসাধু ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ সময়: ১১১৩ ঘণটা, জানুয়ারি ২১, ২০১৭
এসএইচ/এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।