স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় এ শুঁটকি এখনো সারা দেশেই জনপ্রিয়। তবে দেশি মাছের উৎপাদন কমা এবং বেশ কয়েকটি প্রজাতি বিলুপ্তির পথে চলে যাওয়ায় সে চাহিদা ও কদর মেটানো যাচ্ছে না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নাটোর জেলার ৯টি উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে চলনবিল। এক সময় এখানে বিপুল পরিমাণে শুঁটকি মাছ উৎপাদিত হতো। বর্ষা মৌসুম শেষ হলে শুঁটকি উৎপাদনে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন এ অঞ্চলের শত শত ব্যবসায়ী। ঢাকা, রংপুরসহ সারাদেশেই রফতানি হতো এসব শুঁটকি।
কিন্তু কালের বিবর্তন আর নানা অব্যবস্থাপনায় চলনবিলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারানোর পাশাপাশি ক্রমান্বয়ে বিলুপ্তির পথে যাচ্ছে দেশি নানা প্রজাতির মাছ। কিছু কিছু মাছ টিকে থাকলেও নানা প্রতিকূলতায় কমছে সেগুলোরও উৎপাদন। ফলে মাছের অভাবে চাহিদার বিপরীতে শুঁটকি উৎপাদন ও সরবরাহ করতে পারছেন না মৎস্যজীবী ও ব্যবসায়ীরা।
সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, জেলার প্লাবনভূমিতে বছরে প্রায় ৫০ হাজার মণ দেশি মাছ উৎপাদিত হতো কিছুদিন আগেও। বর্তমানে যা ৩১ হাজার মণে এসে দাঁড়িয়েছে। আর মাছের উৎপাদন কমার প্রভাব পড়েছে শুঁটকিতেও।
চলনবিল অধ্যুষিত তাড়াশ উপজেলার মহিষলুটি ও মান্নানগর অঞ্চলে শনিবার (১৮ নভেম্বর) সরেজমিনে গেলে ব্যবসায়ীরা জানান, আগে চলনবিলে মাছ ধরার মৌসুম শেষে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে উঁচু স্থানগুলোতে শুঁটকি তৈরির ধুম পড়তো। উৎপাদিত শুঁটকি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রফতানি করা হতো। এখন দেশি মাছ কম পাওয়া যাচ্ছে। যাও বা পাওয়া যাচ্ছে- তাও দুই/তিনগুণ দামে কিনতে হচ্ছে। বেশি দামে মাছ কিনে তা শুঁটকি করে লাভ হয় না। অনেক ব্যবসায়ী ঋণের টাকায় শুঁটকি উৎপাদনে লাভ করতে না পেরে সর্বশান্ত হয়ে পড়ছেন।
শুঁটকি ব্যবসায়ী নাটোর জেলার গুরুদাসপুর উপজেলার নান্নু হোসাইন বাংলানিউজকে বলেন, ‘আগে কাঁচা মাছ ২০ টাকা কেজিতে কিনে শুঁটকি করতে পারতাম। সেই মাছ এখন ১২০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা কেজিতে কিনতে হচ্ছে। উৎপাদন খরচ বাড়লেও শুঁটকির দাম তেমন বাড়েনি’।
নাটোর জেলার নলডাঙ্গা উপজেলার জাহিদুল ইসলাম এবং সিরাজগঞ্জের তাড়াশের নাজির উদ্দিন ও সিদ্দিকুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন শুঁটকি ব্যবসায়ী জানান, চলনবিলের দেশি মাছের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- পাবদা, পুঁটি, মলা, কই, শিং, মাগুর বোয়াল, চিংড়ি, খলিসা, টেংরা, টাকি, শোল, বাতাসি, গোচি, বাইন, বেলে ও কাকিলা।
গত ৫ বছর ধরে এসব মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ায় শুঁটকির চাতালে সরবরাহ কম হচ্ছে। বেশি দামে মাছ কিনে তুলনামূলক কম দামে শুঁটকি বিক্রি করতে হচ্ছে।
চলনবিল রক্ষা আন্দোলনের সদস্য সচিব এস এম মিজানুর রহমান বলেন, প্রাকৃতিক বিবর্তনের পাশাপাশি উন্নয়নের নামে চলনবিলকে ধ্বংস করা হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে সুতি ও বাদাই জাল দিয়ে এবং বিষ প্রয়োগে পোনা ও মা মাছ নিধন করা হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা শিল্প-কারখানার বর্জ্যও ছড়িয়ে যাচ্ছে পুরো চলনবিলে। এসব কারণেই মাছের উৎপাদন কমছে।
তিনি আরও বলেন, এক সময়ে এখানকার উৎপাদিত সুস্বাদু দেশি শুঁটকি মাছ সারা দেশের চাহিদা মেটাতো। এলাকায় শুঁটকি শিল্পও দিন দিন বাড়ছিল। কিন্তু দেশি মাছের উৎপাদন ক্রমাগত হ্রাস পাওয়ায় শুঁটকির উৎপাদনও আশঙ্কাজনকহারে কমছে।
সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘গত ১০ বছর ধরে প্লাবনভূমিগুলোতে দেশি মাছের উৎপাদন কমছে। তবে মৎস্য বিভাগের তৎপরতায় চলতি বছর উৎপাদন কিছুটা বেড়েছে। শুঁটকির উৎপাদন বাড়াতেও আমরা কাজ করে যাচ্ছি’।
বাংলাদেশ সময়: ০৩২১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১৭
আরএ/এএসআর