শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের দুই দশক পূর্তিতে পার্বত্যাঞ্চলের অধিবাসীদের অভিনন্দন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, যারাই ওখানে বসবাস করছেন, সবাইকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। সুন্দরভাবে; সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে সবাই শান্তিতে বসবাস করবেন, যেন আমরা সার্বিক উন্নতি করতে পারি।
শুক্রবার (১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় গণভবনে পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের ২০তম বার্ষিকী পালন উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতা করছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে কেন্দ্রীয়ভাবে রাঙ্গামাটি স্টেডিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানসহ বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
পার্বত্য শান্তি চুক্তির সুফলের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, চুক্তির পর পার্বত্য এলাকায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় আছে বলে সেখানে উন্নয়নের ছোঁয়াও লেগেছে। সরকার উন্নয়নমূলক কার্যক্রম চালাতে পারছে। রাস্তাঘাট গড়ে উঠেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সুষম উন্নয়নের অংশীদার হয়েছে পার্বত্য জনপদের বাসিন্দারা। এখানকার মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হয়েছে।
সুষম উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পার্বত্য এলাকাসহ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পার্বত্য শান্তি চুক্তির সিংহভাগই বাস্তবায়ন হয়েছে। বিশ্বের আর কোথাও এতো দ্রুত এভাবে চুক্তি বাস্তবায়ন হয়েছে কি-না, আমার জানা নেই। চুক্তির ৭২ শর্তের মধ্যে ৪৮টিই বাস্তবায়ন হয়ে গেছে। ১৫টি আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে। ১৪টির বাস্তবায়ন চলমান। চুক্তির সবচেয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি—ভূমি বিরোধ, সেই জটিলতাও শিগগির সমাধান হবে।
ভূমি বিরোধ নিরসনে আঞ্চলিক পরিষদের সহযোগিতা চান প্রধানমন্ত্রী। একইসঙ্গে চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে পার্বত্যাঞ্চলের বাসিন্দাসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা কামনা করেন।
চুক্তি আরও দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিল মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তারা চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক ছিলো না।
প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দেশে যেভাবে হত্যা-ক্যু ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়, তেমনি পার্বত্য এলাকায়ও আত্মঘাতী সংঘাত শুরু হয়। একটা সময় ছিল, পার্বত্য এলাকায় গেলেও দুপুর ৩টার মধ্যেই ফিরে আসতে হতো।
‘তখন বুঝলাম পার্বত্য চট্টগ্রামের যে সমস্যা, এটা রাজনৈতিক সমস্যা। এর সমাধান রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে। ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে এই সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নিই। আওয়ামী লীগের নেতাদের সমন্বয়ে সেল গঠন করি এবং নিজেও উদ্যোগ নিই। এরমধ্যে মাঝেমধ্যে এমন কিছু ঘটনা ঘটতো, অগ্রহণযোগ্য ছিল। দ্বন্দ্বটা যেন আরও বাড়ানোর অপচেষ্টা ছিলো। একটা পর্যায়ে আমরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তি চুক্তি করতে সমর্থ হই। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চুক্তিতে সই করি। ’
তিনি বলেন, শান্তি চুক্তির অংশ হিসেবে যারা সংঘাতে জড়িত ছিল, আমরা তাদের অস্ত্র সমর্পণ সুযোগ দিই। স্বাভাবিক জীবন-যাপনে ফিরে আসার সুযোগ দিই। সংঘাতের কারণে যে বাসিন্দারা ভারতে শরণার্থী হয়ে যান, তাদের ফিরিয়ে আনি। তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিই, যেটার দায়িত্ব থাকে আমাদের সেনাবাহিনীর হাতে। চাকরি ছেড়ে যাওয়া অনেককে নীতিমালা শিথিল করে ফের চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ দিই।
এ চুক্তি সইয়ের ক্ষেত্রে বাধা পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চুক্তির পর আমরা যেদিন অস্ত্র সমর্পণের অনুষ্ঠান করি, সেদিন বিএনপি হরতাল ডাকে। অস্ত্র সমর্পণে বাধা দেওয়া ছিল তাদের উদ্দেশ্য। আমার মনে হয় তারা অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল। তারা কতো অপপ্রচার করেছিল, বলেছিল চুক্তি হলে পুরো ফেনী পর্যন্ত ভারতের অংশ হয়ে যাবে। এমনকি ভারতের একটি পতাকাও তারা বানিয়েছিল, যেটা আমাদের গোয়েন্দারা চিহ্নিত করে ফেলেন।
সব বাধা পেরিয়ে চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংবিধান মেনে সই হওয়া এই চুক্তির উদ্দেশ্য পার্বত্যাঞ্চলের উন্নয়ন, এখানকার মানুষের জীবনমান উন্নত করা। আজকে সাজেক ভ্যালি পর্যন্ত সরাসরি গাড়িতে যাওয়া যায়।
পার্বত্য অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭০ সালে সাজেক ভ্যালিতে যেতে চেয়েছিলাম। বলা হলো সাত দিন হেঁটে যেতে হবে সাজেক ভ্যালিতে। এখন সেখানে গাড়িতে যাওয়া যায়। শুধু সাজেক নয়, পার্বত্যাঞ্চলের সব এলাকায় দ্রুত উন্নয়ন হচ্ছে। এখন যেমন রাস্তাঘাট হয়ে গেছে, তেমনি ওই অঞ্চলের মানুষ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ফলমূল সব বাজারজাত করতে পারছে।
সরকারপ্রধান পার্বত্যাঞ্চলে উন্নয়নের কার্যক্রম তুলে ধরে বলেন, সেখানে পর্যাপ্ত স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছি। ইউনিয়নের সংখ্যা বাড়িয়েছি। রাস্তাঘাট করতে গিয়ে ক’দিন আগেই থানচিতে আমাদের সেনা সদস্য মৃত্যুবরণ করেছেন।
চুক্তির বাইরেও সরকার পার্বত্য জনপদের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চাকরির ক্ষেত্রে পার্বত্যবাসীর জন্য কোটার ব্যবস্থা করেছি। দেশে সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। সেজন্য পার্বত্য জনপদকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় করারও ব্যবস্থা নিয়েছি আমরা। যেন আমাদের সন্তানেরা নিজেদের এলাকায় থেকেই পড়াশোনা করতে পারে।
অনুষ্ঠানে গণভবন প্রান্তে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং প্রমুখ।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০১৭/আপডেট ২২০৫ ঘণ্টা
এমইউএম/এইচএ/
** পার্বত্য এলাকায় শান্তি আছে বলে উন্নয়নও হচ্ছে