রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির জন্য এটা নতুন নয়। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসের সহিংসতায়ও বহু বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, নির্যাতিত বা ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
এবারের পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে তথাকথিত ‘নির্মূল অভিযানটি’ শুরু হয় ২৫ আগস্টে। মিয়ানমারের পুলিশ বাহিনীর ওপর নবগঠিত আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা) সমন্বিত হামলা চালানোর পর।
বেসামরিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির ওপর নির্বিচার হামলাকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী আরসা’র হামলার জবাব হিসেবে চালিয়ে দিতে চাইলেও চকিত নজরে রোহিঙ্গা নির্যাতনের ইতিহাসের দিকে তাকালেই প্রকৃত চিত্রটা স্পষ্ট হবে। রোহিঙ্গারা কোনো কারণ ছাড়াই পদ্ধতিগতভাবেই সরকারের দমন-নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। রোহিঙ্গাদের ওপর যে সহিংসতা চলছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাকে ‘এথনিক ক্লিনজিং বা ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ ও ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ বলে আখ্যা দিয়েছে। এছাড়া ইয়েল ল স্কুল (Yale Law School) ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় (University of London) পরিচালিত গবেষণাসহ একাধিক গবেষণায় বলা হয়েছে, এসব দমন নির্যাতন ১৯৪৮ সালের Convention on the Punishment and Prevention of the Crime of Genocide-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী গণহত্যার সামিল।
তাহলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কেন রাখাইন রাজ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতার পরিচয় দিল? কেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর শতবার আহবান সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের ওপর একের এক এক সহিংসতার ঘটনা ঘটে চলেছে? কোন সে বাস্তবতার রাজনীতি যা বারবার শান্তি প্রচেষ্টাকে ভণ্ডল করে চলেছে?
নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যাবে, মিয়ানমার এমনই এক দেশ, আন্তর্জাতিক রীতিনীতি বা কূটনীতির প্রতি যেদেশের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই। রাখাইনের সহিংসতার তদন্ত করতে আগ্রহী জাতিসংঘ দলকে ভিসা দেবে না বলে দিয়ে মিয়ানমার তা আবারও প্রমাণ করলো। দুর্গতদের সাহায্য দিতেও ডব্লুএফপিকে (WFP) বাধা দিয়েছে দেশটি।
এমনকি মিয়ানমারের পরিস্থিতির ওপর স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ের জাতিসংঘ প্রতিনিধি ইয়াঙ্গি লিকে (Yanghee Lee) দেশটির শীর্ষস্থানীয় ভিক্ষু ‘বেশ্যা’ বলে অভিহিত করেছেন। লি-র দোষ তিনি দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছিলেন।
মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে সেদেশে যাওয়া ‘অবৈধ জনগোষ্ঠি’ বলে মনে করে। ১৯৮২ সালে কালো আইনের আওতায় রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি রহিত করা হয়। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে ভিক্ষু, সরকার এবং গণতন্ত্রমনা রাজনীতিক সবার অবস্থানই এক। এমনকি ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটাই সেখানে এক ট্যাব্যু।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিলম্বিত সাড়ার কারণে রোহিঙ্গাদের মধ্যে তো বটেই, এমনকি অনেক বাংলাদেশির মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল যে, মুসলমানদের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোভাব বৈষম্যমূলক। এমন ধরণের বর্বর সহিংসতার ছিটেফোঁটাও যদি পশ্চিমা কোনো দেশে ঘটতো তাহলে ব্যাপারটা অন্যরকম হতো। সাড়াটাও হতো তীব্র আর জোরালো।
এ ধরনের জল্পনার বাইরেও বাস্তবে অনেক কিছুই ঘটে চলেছে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর সহিংসতার পক্ষে দেশটির ভেতরে ঢালাও সমর্থন রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হুশিযারি উচ্চারণ না করলে দেশটির সরকার ও সেনাবাহিনী থোড়াই কেয়ার করতো।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের মোক্ষম জায়গা। কিন্তু সেখানেও মিয়ানমারের বিশ্বস্ত বন্ধু চীনের কারণে সেপথ বন্ধ। আগস্টে শুরু হওয়া সহিংসতার পর ব্রিটেন নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আহবান করেছিল, কিন্তু চীন সেখানেও বাধ সাধে। ফলে জাতিসংঘের পক্ষে জোরালো ও কার্যকর ভূমিকা পালন সম্ভব হয়নি।
মিয়ানমারে চলমান সহিংসতার ওপর গত মার্চ মাসে একটি press statement নেওয়ার উদ্যোগেও ভেটো দেয় চীন ও রাশিয়া। ২০০৭ সালেও মিয়ানমারে রাজনৈতিক দমন পীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধে নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রস্তাবে ভেটো দেয় চীন ও রাশিয়া। চীনের স্বার্থটা আসলে কিয়ায়ুকপিয়ুতে (KyaukPyu) ৭৩০ কোটি মার্কিন ডলারের একটি গভীর সমুদ্রবন্দরে। যা চীনের ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ প্ল্যানের অংশ।
রয়টার্সের প্রতিবেদন বলছে:
কিয়ায়ুকপিয়ু চীনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা চীনের একটি তেল ও গ্যাস পাইপলাইনের কিয়ায়ুকপিয়ু হচ্ছে প্রবেশপথ। এটি মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি আনার বিকল্প পথ হিসেবে কাজ করবে। মালাক্কা প্রণালীকে এড়ানোর সুবর্ণ সুযোগ এনে দেবে কিয়ায়ুকপিয়ু।
বলাবাহুল্য, কিয়ায়ুকপিয়ুর (KyaukPyu) অবস্থান রাখাইন রাজ্যে।
আরেক আঞ্চলিক শক্তি ভারত কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে নীরব। তারা মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও সামরিক সম্পর্ক গড়ার জন্য চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। জুলাইতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাতমাদাউর (Tatmadaw) সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাং (Min Aung Hlaing) ভারত সফর করে এসেছেন এবং ভারতের সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। সাক্ষাৎ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে।
নেইপিদোর সঙ্গে ঘনিষ্ট কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করে চলার বাইরেও তাতমাদাউর (Tatmadaw) সঙ্গে ভারত এক বিশেষ সম্পর্ক রক্ষা করছে। তারা তাতমাদাউর (Tatmadaw) কাছে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র বিক্রি করছে। মানবাধিকার লংঘনকারী একটি নির্যাতক সেনাবাহিনীকে অস্ত্রবলে শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে ভারত যা করছে, তাতে যে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়বে, সে বিষয়ে ভারত মোটেই ভাবিত নয়।
আঞ্চলিক অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আসিয়ানের (ASEAN) যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে মিয়ানমারের পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানোর। কিন্তু সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতির কারণে আসিয়ানেরও হাত-পা বাঁধা।
কেবল তুরস্ক, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়ার মতো কয়েকটি দেশ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জোরালো বিবৃতি দিয়েছে। তবে এমন কথাও বলাবলি হয়, এসব দেশের শীর্ষ নেতারা নিজ নিজ দেশের ভেতরে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠির সমর্থন লাভের জন্যই মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বড় বড় বুলি আওড়ান। আসলে কাজের কাজ কিছুই করেন না তারা।
শরণার্থীদের অব্যাহত ঢলের কারণে সবচেয়ে ক্ষতির শিকার বাংলাদেশ। বাংলাদেশ শরণার্থীদেরকে মানবিক সাহায্য সহযোগিতা দিতে এবং তাদের নিজেদের দেশে ফিরিয়ে নেবার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সমর্থন ও সহযোগিতা আদায়ে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবার প্রক্রিয়া শুরু করার বিষয়ে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে অতি সম্প্রতি একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে।
অবশ্য সবকিছুই নির্ভর করছে মিয়ানমার সরকারের ওপর। যতক্ষণ না মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও আইনগত অধিকারের নিশ্চয়তা দেবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ফিরিয়ে দেবার প্রক্রিয়াতেও সমস্যার স্থায়ী সমাধান মিলবে না। মূল কারণগুলো যদি মিয়ানমার নিজেই দূর না করে তাহলে রোহিঙ্গাদের দমন-নিপীড়ন-নির্যাতন এবং তাদের দলে দলে পালিয়ে আসা আবারও ঘটবে।
আশরাফুল আজাদ: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অ্যাসিসট্যান্ট প্রফেসর ও অ্যাকটিং চেয়ারপারসন।
বাংলাদেশ সময়: ২৩৩১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০১৭
জেএম