যুদ্ধকালীন রাজবাড়ী সদর থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ডা. কামরুল হাসান লালী বাংলানিউজকে জানান, রাজবাড়ী মূলত রেলওয়ের শহর হিসেবে পরিচিত। এ কারণে পাকিস্তান আমলে এখানে রেলওয়েতে কর্মরত ছিলো প্রায় ২০ হাজার অবাঙালি বিহারী।
জেলা শহরের নিউ কলোনি, আঠাশ কলোনি, রেল কলোনি, বিনোদপুর ও লোকশেড এলাকায় ছিলো তাদের বসবাস। সুযোগ পেলেই তারা নিরীহ বাঙালিদের উপর চালাতো নির্মম হত্যাযজ্ঞ। স্বাধীনতার নয় মাস জেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রকাশ্যে গণহত্যা, লুটতারাজ ও মহিলাদের ইজ্জত হরণ করে এক ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিলো প্রভাবশালী এসব বিহারীরা।
তিনি আরও জানান, ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল ভোর ৫টার দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গান বোটের মাধ্যমে পদ্মা নদী পার হয়ে গোয়ালন্দ ঘাট অতিক্রম করে নারার টেক ও মমিন খাঁর হাট দিয়ে রাজবাড়ী শহরে প্রবেশ করতে থাকে। এসময় তাদের বাধা দেওয়ার যুদ্ধে প্রথম শহীদ হন গোয়ালন্দের আনছার কমান্ডার ফকির মহিউদ্দিনসহ প্রায় শতাধিক বাঙালি। এরপর ২২ নভেম্বর রাজবাড়ীর আলাদীপুর ব্রিজের কাছে সম্মুখযুদ্ধে প্রথম শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধা সহকারী কমান্ডার আব্দুল আজিজ খুশি।
এরপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজবাড়ী শহরে প্রবেশ করে বিহারী নেতা ছোয়েদ খামারের নেতৃত্বে অসংখ্য বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। বিহারীরা ও পাক বাহিনী একত্রিত হয়ে জেলার বিভিন্ন এলাকায় লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ এবং নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে।
নভেম্বরের শেষের দিকে পাকিস্তানি সেনারা ফরিদপুরে চলে যায়। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে অবাঙালি বিহারীদের আক্রমণের প্রস্তুতি নেন।
ডিসেম্বরের শুরু থেকেই বিহারীদের আর বুঝতে বাকি থাকে না যে তাদের পতন ঘনিয়ে আসছে। তাই ৬ ডিসেম্বরের পর থেকে তারা অতিমাত্রায় তৎপর হয় ওঠে এবং পুরো শহর দখল করে রাখে। রাজবাড়ীকে স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে আলাদা করে রাখতে বিহারী বসতি এলাকা ঈশ্বরদী ও পার্বতীপুর থেকে তারা আরও বিহারী এনে রাজবাড়ী শহরে শক্তিশালী ঘাঁটি তৈরি করে। ৯ ডিসেম্বর শহরের লক্ষ্মীকোল লোকোশেড এলাকায় বিহারীদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধে বিহারীদের গুলিতে রফিক, শফিক ও সাদিক শহীদ হন।
মুক্তিযোদ্ধা ডা. কামরুলল হাসান লালী আরও জানান, ১৩ ডিসেম্বর বিহারীরা বিনোদপুর বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রহরীকে হত্যা করে পুরো শহরে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেয়। ১৬ ডিসেম্বর প্রায় সারাদেশে পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও রাজবাড়ী শহর তখনও অবাঙালি বিহারীদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। বিহারীরা ঘোষণা দেয় সারাদেশ বাংলাদেশ হলেও রাজবাড়ী পাকিস্তান হয়ে থাকবে।
এ সময় জেলার সব অঞ্চল থেকে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন দল রাজবাড়ীতে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে সংগঠিত হতে থাকে। ইতিমধ্যে তিনিসহ (ডা. কামরুল হাসান লালী), শহিদুন্নবী আলম, ইলিয়াস মিয়া, সিরাজ আহম্মেদ, আবুল হাসেম বাকাউল, রফিকুল ইসলামের কমান্ডে মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে চারিদিকে থেকে বিহারী অধ্যুষিত এলাকাগুলো ঘিরে ফেলেন। রাজবাড়ীকে বিহারী ও রাজাকার মুক্ত করার জন্য পাংশা থেকে জিল্লুল হাকিম, নাসিরুল হক সাবু, আব্দুল মতিন, আব্দুল মালেক, সাচ্চু ও প্রফেসর আব্দুর রব তাদের বাহিনী নিয়ে রাজবাড়ীতে ছুটে এসে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
এক পর্যায়ে ১৮ ডিসেম্বর অবাঙালি বিহারীরা শহরের রেল লাইনের উত্তর পাশে অবস্থান নেয়। তারা রেলওয়ে লোকশেড থেকে ড্রাই আইস ফ্যাক্টরি পর্যন্ত রেলের মালগাড়ি দিয়ে প্রতিরোধ দেয়াল তৈরি করে রাখে। এসময় মুক্তিবাহিনীরা শহরের দক্ষিণ দিক থেকে গুলি চালাতে থাকেন। তবে মালগাড়ি থাকার কারণে সফলতা পেতে বেগ পেতে হয়। সে সময় গোলাম মোস্তফা ও আনিসুর রহমান আবি মাগুরার শ্রীপুর থেকে মর্টার সেল আনেন। ওই মর্টার সেল ছুড়লে বিহারীরা পিঁছু হটে। এরপর পরাজয় অনিবার্য বুঝতে পেরে বিহারীরা আত্মসমর্পন করার উদ্দেশে ফরিদপুর অভিমুখে যেতে থাকে। তবে তাদের সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি। ওই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বেশ সংখ্যক বিহারী নিহত হয় এবং বেশ সংখ্যক বিহারী পালিয়ে যায়। এছাড়াও অন্যান্য বিহারী আত্মসর্মপণ করে। এ যুদ্ধে দিয়ানত আলী শহীদ হন এবং ইলিয়াস মিয়া গুরুতর আহত হন। এভাবেই ১৮ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয় রাজবাড়ী।
বাংলাদেশ সময়: ০৩২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৭
এসএইচ