উখিয়ায় যখন নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হয় সে সময়ের স্মৃতিচারণ করছিলেন থাইংখালী গ্রামের হাফেজ শাহ আলম। তিনি বলেন, তখন রোহিঙ্গাদের না ছিলো মাথা গোঁজার ঠাঁই, না ছিলো খাবার।
হাফেজ শাহ আলম বলেন, বড় জটিল সময়ে প্রথম চিকিৎসা দিতে হাজির হয়েছিল আদ-দ্বীন হাসপাতাল। অনেকটা অন্ধকারে আলোক বর্তিকার মতো ছিলো। রাতদিন পরিশ্রম করে গেছে। ক্যাম্প অফিসের পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ টিম রোহিঙ্গাদের তাবুতে গিয়ে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ পৌঁছে দিয়েছে।
শুধু শাহ আলম নয় আদ-দ্বীন হাসপাতাল, ডাক্তার ও নার্সদের সম্পর্কে অনেকেই এমন ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। অনেকে মন্তব্য করেছেন, আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা এবং এনজিও পরিচালিত হাসপাতাল রয়েছে। সেখানে গেলে সামান্য ওষুধ দিয়ে বিদায় করেছে। কিন্তু আদ-দ্বীন শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ওষুধের পুরোপুরি ডোজ ফ্রি দিয়েছে। যে কারণে অন্য হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নেওয়ার পরও অনেকে এখানে এসেছেন।
মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) বিকেলেও বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নারীকে আদ-দ্বীনের ক্যাম্প হাসপাতালে ভীড় করতে দেখা গেলো। তারা সরাসরি হাজির হচ্ছেন ডাক্তারের কাছে, আবার ডাক্তারের ভাষা বুঝতে যাতে সমস্যা না হয়, সে জন্য চটপটে কয়েকজন দোভাষী রাখা হয়েছে। যারা রোগী এবং ডাক্তাদের মধ্যে সেতুবন্ধন করে দিচ্ছেন।
দোভাষীর দায়িত্বে থাকা থাইংখালী গ্রামের কলেজ ছাত্রী ফাতেমা খাতুন জানান, তারা দেখেছেন অনেকে ডাক্তারের ভাষা শুনে ভয় পেতো। মিয়ানমান সেনাবাহিনীর ভাষা যেমন বুঝতো না তেমনি ডাক্তার নার্সদের ভাষা বুঝতে না পেরে প্রথম দিকে ভয় পেতো। তাদের ভাষায় কথা বলা শুনে আপন করে নিয়েছেন।
দোভাষীর সেই বক্তব্যের সঙ্গে ক্যাম্পের ডাক্তার-নার্সরাও সুর মিলিয়েছেন। বলেছেন ওরা আমাদের কাজটাকে অনেক সহজ করে দিয়েছে।
আদ-দ্বীন হাসপাতালটি চালুর গল্পটাও কিন্তু পুরোপুরি আলাদা। বিজ্ঞাপন দিয়ে বলা হয়েছিলো যারা রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতে চান তাদেরকেই খুঁজছে আদ-দ্বীন। পুরোপুরি চাকরি নয়, কিন্তু চাকরির মতো। আর তাতেই সাড়া দিয়ে আন্তরিক সেবার ব্রত নিয়ে এসেছিলেন অনেকে।
আর আন্তরিক সেবার ব্রত থাকায় অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান বিশাল পরিসর নিয়ে হাজির হলেও সীমিত পরিসরের আদ-দ্বীন এখানে আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল।
নুর হাসিনা নামের এক রোহিঙ্গা জানালেন, তার সন্তুষ্টির কথা। বললেন, আমি অন্য একটি হাসপাতালে গেছিলাম চিকিৎসা নিতে। তারা আমাকে মাত্র একদিনের ওষুধ দিয়েছিলো তাও পুরোপুরি নয়। বাজার থেকে ওষুধ কিনতে বলা হয়েছিলো।
আমার কাছে টাকা না থাকায় বাধ্য হয়ে আগের প্রেসক্রিপশন গোপন করে আদ-দ্বীন হাসাপাতালে গিয়েছিলাম। এবার আমাকে ভিটামিন, ক্যালসিয়ামসহ মোট চারপদের ওষুধ দিয়েছিলো। সেগুলো খেয়েই অনেকটা ভালো হয়ে উঠেছি। আরেকবার এলেও অনেকগুলো ওষুধ দিয়েছে।
তাজনিমা খোলা ক্যাম্পে গিয়ে দেখা হয় দশ সন্তানের জননী আনোয়ারা বেগমের সঙ্গে। খুব শিগগিরই একাদশ সন্তাদের মা হতে চলেছেন। তার নিজগ্রাম কৈল্লাডাঙ্গায় মিয়ানমান সেনাবাহিনীর নির্মমতা উপেক্ষা করে আত্মগোপন করেছিলেন বেশ কিছুদিন। কিন্তু শেষ রক্ষা না হওয়ায় সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। তখন তার পেটের সন্তানের বয়স সবে তিন মাস।
যখন তার ভালোমন্দ খাওয়ার ও বিশ্রাম নেওয়ার কথা। তখন ভালোমন্দ খাবার থাকাতো দূরের কথা কয়েকদিন গেছে অনাহারে। আবার পালিয়ে থেকে থেকে শরীর হয়ে পড়েছিলো কঙ্কাল। সেই আনোয়ারা বেগম আদ-দ্বীনের দারস্থ হলে তাকে অনেকগুলো ভিটামিন ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট দেয়া হয়েছিল। সেগুলো খেয়ে এখন আবার স্বাস্থ্য ফিরে পেয়েছেন তিনি। সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা বলতে বলতে এক সময় তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। চোখ মুছে নিয়ে বলেন, চোখের সামনে কতজনের বিভৎস লাশ দেখেছি। বাঁচতে পারবো কখনও কল্পনাও করিনি।
আদ-দ্বীন হাসপাতালের পরিচালক ডা. নাহিদা ইয়াসমিনের সঙ্গে কথা হয় ক্যাম্পেই। তিনি বলেন, একটি ক্যাম্প হাসপাতাল ছাড়াও ভ্রাম্যমাণ টিমের মাধ্যমে সেবা দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের সেবাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা যখন কাজ শুরু করি তখন অবস্থা ছিলো খুবই ভয়াবহ। এখন পরিস্থিতি অনেক বদলে গেছে। অনেকে সেবার হাত প্রসারিত করেছে।
৫টি অ্যাম্বুলেন্স ছিলো রোগী আনা নেওয়ার জন্য। ভ্রাম্যমাণ টিম খোঁজ দিলেই সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যেতো অ্যাম্বুলেন্স। প্রথমে ক্যাম্প হাসপাতালে নেওয়া হতো। আর ক্যাম্প হাসপাতাল প্রয়োজন মনে করলেই জেলা ও উপজেলা সদর হাসপাতালে পৌঁছে দেয়া হতো। তখন আমরা ছাড়া আর কেউই এতো অর্গানাইজ ওয়েতে কাজ করেনি।
গত সেপ্টেম্বর একটি একতলা পাকাবাড়িতে রোহিঙ্গাদের জন্য থাইংখালী ফিল্ড হাসপাতালটি চালু করে আকিজ গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আদ-দ্বীন হাসপাতাল। ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত এখানে ৬ হাজার ৭৬৩ জন গর্ভবতী, ১ হাজার ৮২৩ জন প্রসূতি এবং ৫ হাজার ২৫৬ জন সাধারণ রোগী চিকিৎসা সেবা নিয়েছে। যাদের সবাইকে ব্যবস্থাপত্রের পাশাপাশি পুরোপুরি ওষুধও ফ্রি দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ভ্রাম্যমাণ টিম তাবুতে তাবুতে গিয়ে বিভিন্ন রকমের পরীক্ষাসহ মোট ১০ হাজার ৭১১ জনকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে বিরল নজির গড়েছেন। এমনও হয়েছে ভ্রাম্যমাণ টিম খোঁজ দিয়েছেন, অ্যাম্বুলেন্স গিয়ে তাকে এনে প্রসব করিয়ে আবার ক্যাম্পে পৌঁছে দিয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৪ ঘণ্টা, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৭
এসআই/আরএ