মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্যাম্প করে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সমবেত হয়েছিলেন বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধারা।
এ অবস্থায় ২০ ডিসেম্বর সকাল ৯টার দিকে হঠাৎ ক্যাম্পে ভয়াবহ মাইন বিস্ফোরণ ঘটে।
সেই থেকে প্রতি বছর ২০ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারে পালিত হয়ে আসছে স্থানীয় শহীদ দিবস হিসেবে।
সেদিনের শক্তিশালী মাইন বিস্ফোরণে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। সেখানে প্রতি বছর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আসছেন জেলার সর্বস্তরের মানুষ। দিবসটি পালনে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করে মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন সংগঠন।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- সুলেমান মিয়া, রহিম বক্স খোকা, ইয়ানুর আলী, আছকর আলী, জহির মিয়া, ইব্রাহিম আলী, আব্দুল আজিজ, প্রদীপ চন্দ্র দাস, শিশির রঞ্জন দেব, সত্যেন্দ্র দাস, অরুণ দত্ত, দিলীপ দেব, সনাতন সিংহ, নন্দলাল বাউরি, সমীর চন্দ্র সোম, কাজল পাল, হিমাংশু কর, জিতেন্দ্র চন্দ্র দেব, আব্দুল আলী, নুরুল ইসলাম, মোস্তফা কামাল, আশুতোষ দেব, তরণী দেব ও নরেশ চন্দ্র ধর।
তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডিং অথরিটি মৌলভীবাজার জেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান বাংলানিউজের কাছে সেদিনের ভয়াবহতার বর্ণনা করেছেন।
তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে মৌলভীবাজার থেকে বিতাড়িত করে ০৮ ডিসেম্বর কাঙ্খিত বিজয় অর্জন করেন মুক্তিযোদ্ধারা। তারপর জেলার বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থানকারী যোদ্ধারা এসে মৌলভীবাজার শহরের সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ক্যাম্পে অবস্থান নেন’।
‘পাকিস্তানি বাহিনীর পুঁতে রাখা মাইন ও রেখে যাওয়া প্রচুর অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা এনে ক্যাম্পের সামনের খোলা জায়গায় রেখেছিলেন। মাইনগুলোর বেশিরভাগ ছিল ‘অ্যান্টি ট্যাংক’। আমি সেদিন কমান্ডিং অথরিটি হিসেবে সকালে ক্যাম্প পরিদর্শন করে বের হয়ে মাইনগুলো দেখে সবাইকে সতর্ক করেছিলাম। তারপর বের হয়ে পড়ি সেখান থেকে’।
তিনি বলেন, ‘এর কিছুক্ষণ পর সকাল ৯টার দিকে হবে, হঠাৎ বিকট শব্দে একেক করে অগণিত মাইন বিস্ফোরিত হতে থাকে। কালো অন্ধকারে ঢাকা পড়ে আশেপাশের এলাকা। গাছের ডালে, স্কুলের ছাদে, খোলা মাঠে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের দেহের বিভিন্ন অংশ। সেদিন শহীদ হন ২৪ জন মুক্তিযোদ্ধা’।
‘সেদিনের ধারাবাহিক বিকট শব্দে শহরের মানুষ ওদিক-এদিক ছোটাছুটি করছিলেন। এতো বিকট শব্দ ছিল যে, ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠেছিল পুরো শহর। অনেক মানুষের ঘর-বাড়ি ভেঙে পড়েছিল। আমি স্কুলের কাছাকাছি ছিলাম। ২/৩টি শব্দের পরে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। কতোগুলো ‘অ্যান্টি ট্যাংক এক্সক্লুসিভ মাইন’ বিস্ফোরিত হয়েছিল, তা বুঝে ওঠার উপায় ছিল না’।
আজিজুর রহমান বলেন, ‘তারপর চিরচেনা সহযোদ্ধাদের দেহের বিভিন্ন অংশ কুড়িয়ে বের করতে হয়েছিল। উড়ে গিয়ে হাত এক জায়গায়, পা এক জায়গায় আবার শরীর অন্য জায়গা পড়েছিল তাদের। কারো কারো শরীরই পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন চিহ্ন যেমন, ঘড়ি, জামা, আংটি ইত্যাদি পাওয়া গিয়েছিল শুধু। সেগুলো থেকেই তাদের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছিল। শহীদ ২৪ জনকে এক জায়গায় সমাহিত করা হয়। সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠের পূর্ব-দক্ষিণ পাশে আলাদাভাবে হিন্দুদের দাহ আর মুসলিমদের কবর দেওয়া হয়েছিল। সেখানে এখন তাদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে’।
বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৭
এএসআর