এতে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ঢুকে পড়ছে একশ্রেণির বর্ণচোর। যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া তো দূরের কথা এর ধারেও কোনদিন ঘেঁষেননি।
তবে তাদের এই দাপট বেশিদিন টিকবে না এমন কথাই জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। গত বৃহস্পতিবার ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে বাংলানিউজকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাতকারে এসব কথা বলেন তিনি।
মাত্র কয়েকদিন আগেই ৪৭ তম বিজয় দিবস উদযাপন করলো বাঙালি জাতি। স্বাধীনতার সুদীর্ঘকাল অতিক্রম করলেও এখনো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিরুপণ হয়নি। কেন হয়নি, কেনই বা অমুক্তিযোদ্ধারা তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন এসব বিষয়ও তুলে ধরেন তিনি।
তুরিন আফরোজ বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন নিঃসন্দেহে জাতির জন্য সূর্য সন্তান। কাজেই একজন মুক্তিযোদ্ধাকে অপমান করা মানে পুরো বাঙালি জাতিকে অপমান করা। মনে রাখতে হবে তাদের অবদানেই বাঙালি জাতির অস্তিত্ব। কিন্তু দুঃখ লাগে যখন দেখি এই সমাজে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা বুক উঁচিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা শুধু মুক্তিযোদ্ধা নামটিই কলঙ্কিত করছেন না, তারা ইতিহাস বিকৃত করছেন।
মুক্তিযুদ্ধে তারা অংশ গ্রহণ করেননি, কিন্তু পরিচয় দিচ্ছেন তারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ঠেকাতে কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। কিন্তু আজ অবধি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ঠেকাতে তেমন কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিভিন্ন সরকার বিভিন্ন ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞায়িত করেছেন। যা জাতির জন্য হতাশার একই সঙ্গে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অপমানেরও বটে।
এ নিয়ে তুরিন আফরোজ বলেন, এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় ১২ বার পরিবর্তন হয়েছে।
সব শেষ পরিবর্তন হয়েছে সর্বনিম্ন বয়স সাড়ে ১২ তে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে । এভাবে বার বার সংজ্ঞায়িত করার ফলে অনেক সুযোগ সন্ধানী সুবিধাবাদী লোক নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা দাবি করছেন। এই সুযোগটা তারা গ্রহণ করছেন।
কেন, কিভাবে ভুয়া ও অমুক্তিযোদ্ধারা তালিকায় আসছে? এমন প্রশ্ন রাখাতে হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের পছন্দ অনুযায়ী একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করেছেন। যদিও বর্তমানে প্রক্রিয়াটি অনেক উন্নত হয়েছে।
তবে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু যেভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞায়িত করেছিলেন, সেখান থেকে তার ব্যাপ্তি বড় করেছি বটে। কিন্তু এখন একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার তার নিজের ‘রিকমান্ডেশনে’কাউকে তিনি মুক্তিযোদ্ধা বানাতে পারেন আবার চাইলে কাউকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ দিতে পারেন।
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার একটি উদাহরণ টেনে বলেন, এক ব্যক্তি টেলিভিশনের সামনে বলেছিলেন আমি মুক্তিযুদ্ধকালীন যদি যুদ্ধে যেতে পারতাম তবে অনেক গর্ববোধ করতাম। এমনকি যখন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) তার এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই করলো তখন জেলা কমান্ডারই বললেন তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন।
মুক্তিযুদ্ধ করেননি, তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়সও এত কম ছিল, এ কথা ৬টি টিভি চ্যানেলে প্রচার করা হয়েছে। অথচ ঠিক ১৫ দিনের মাথায় ওই কমান্ডারই বললেন উনি মুক্তিযোদ্ধা। আবার গাজীপুরে খোলামেলা ভাবে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট বিক্রি হচ্ছে, তার রেট (দর) আছে, যে কমান্ডারকে এতো টাকা দিলেই সার্টিফিকেট পাওয়া যায়। কি রকম একটি জঘন্য প্রক্রিয়ার মধ্যে আমরা চলে গেছি বলেন তুরিন।
বরিশালের একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা যিনি এখন বরিশালের জেলা কমান্ডার। তার বিরুদ্ধে কোর্টে একটি মামলাও রয়েছে।
সে প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, দেখুন একজন রাজাকার যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা মাস মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। এক সময় আহত হয়ে নভেম্বরের দিকে ভারত গেলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজেকে আহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। এখন তিনিই বরিশালে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হিসেবে রয়েছেন। এখন তিনিই নাকি মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই করবেন!তুরিন আফরোজ বলেন, মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়াটা আরো স্বচ্ছ করা যেতে পারতো। এখনো আমরা এটাকে স্বচ্ছ করতে পারি। একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যেতে পারে। যেমন আমাদের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব্যুনাল রয়েছে, লেবার ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। ঠিক সেভাবেই আমাদের লাল মুক্তি বার্তা বা ভারত থেকে প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকার বাইরে যদি কেউ মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট চান বা মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেন তাহলে তাদের জন্য একটা ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হোক। একজন প্রাক্তন বিচারপতির নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সচিব ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে থেকে একজনকে নিয়ে একটি প্যানেল করে দিলে তাদের মাধ্যমে আমরা যাচাই-বাছাই করতে পারি।
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের পরিসংখ্যান তুলে ধরে তুরিন আফরোজ বলেন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীই তথ্য দিয়েছেন, বিএনপি আমলে ২২ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। আওয়ামী লীগ আমলে সাড়ে ১১ হাজার। সংখ্যা যাই হোক মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। তাই আমাদের পরিষ্কার করতে হবে। এজন্য একটি জুডিশিয়ারি বডি তৈরি করা উচিত।
তুরিন আফরোজ বলেন, আমাদের দণ্ড বিধির ৪১৬ ধারায় বলা হয়েছে ‘ইমপারসোনেশিয়ান (নিজেকে অন্য নামে পরিচয় দেওয়া)। এটি করলে দণ্ডনীয় অপরাধ। দণ্ডবিধির ৪১৯ ধারায় তার সর্বোচ্চ ৩ বছরের শাস্তি হতে পারে সঙ্গে জরিমানাও। কাজেই একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা যখন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিচ্ছেন, উনি তো ৪১৬ ধারা ভঙ্গ করেছেন। কাজেই ৪১৯ ধারা অনুযায়ী তার শাস্তি হওয়া উচিত।
জালিয়াতির শাস্তি কি? এর আইনি ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, যারা জালিয়াতির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট গ্রহণ করছেন, তারা তো আসলে একটি জাল দলিল তৈরি করছেন। সুতরাং দণ্ডবিধির ৪৭১ বিধি অনুযায়ী এটি একটি অপরাধ, এছাড়া ৪৬৩ বিধিতেও অপরাধের কথা বলা আছে। এর জন্য ৪৬৩ বিধি অনুযায়ী সর্বোচ্চ দুই বছরের জেল হতে পারে। কেননা এটা তো একটি প্রতারণা। আবার দণ্ডবিধির ৪৬৮ ধারা অনুযায়ী প্রতারণা করার উদ্দেশে জালিয়াতির শাস্তি ৭ বছর পর্যন্ত জেল।
আর কেউ মিথ্যা সার্টিফিকেট ব্যবহার করলে সংবিধানের ১৯৮ ধারায় শাস্তির কথা বলা আছে। কাজেই পেনাল কোর্ডে এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অবস্থা নিয়ে তাদের ফৌজদারি কার্যক্রম করা সম্ভব। এর বাইরেও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বা যে কোন নাগরিক তাদের বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে মামলা করতে পারেন। আমাদের সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একজন মানুষের সুনাম রক্ষা করার অধিকার হচ্ছে তার মৌলিক অধিকার। কাজেই বিদ্যমান আইনেও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিচার করা যেতে পারে, সঙ্গে তাদের মদদ দাতাদেরও একই আইনে বিচার করা সম্ভব।
প্রকৃতি মুক্তিযোদ্ধারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে মামলা করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার যথেষ্ট জায়গা রয়েছে। তাছাড়া আমাদের নতুন একটি আইন হতে যাচ্ছে যেখানে ইতিহাস বিকৃত করলে কি শাস্তি হবে তা উল্লেখ থাকবে। এই আইন পাস হওয়ার আগেও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সিন্ডিকেটের বিচার করা যেতে পারে। কেন না একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ৩০ লাখ শহীদের সঙ্গে প্রতারণা করছে, প্রতারণা করছে ৫ লাখ নির্যাতিতা মা-বোনের সঙ্গে, সর্বোপরি প্রতারণা করছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে।
বাংলাদেশ সময়: ১২০৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১৭
এসএম/ইএস/আরআই