যশোরের কয়েকজন পরিবেশবাদী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বললেও তারা কোনো আন্দোলন-মানববন্ধনে যাননি। জেলা প্রশাসক, সংসদ সদস্যসহ দায়িত্বশীল মহল গাছ কাটা সংক্রান্ত মিটিংয়ে অংশ নিলেও সবাই সম্মতি দিয়েছেন।
সর্বশেষ ৬ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে যশোর-বেনাপোল সড়ক নির্মাণ ও প্রশস্তকরণের সুবিধার্থে রাস্তার দু’পাশের গাছ অপসারণ বিষয়ে মতবিনিময় সভায় তিনজন সংসদ সদস্য, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, জনপ্রতিনিধি ও সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সর্বসম্মতিক্রমে গাছগুলো কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন।
তবে বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে চলছে তোলপাড়। বিশিষ্টজনেরা কলাম লিখে গাছ বাঁচানোর জন্য আঁকুতি জানাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বসে নেই পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোও। মঙ্গলবারও (১৬ জানুয়ারি) রয়েছে কয়েকটি মানববন্ধন কর্মসূচি।
সরব না থাকলেও গাছ কাটার কুফল ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ কয়েকজন পরিবেশবাদী।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সাইবুর রহমান মোল্যা বাংলানিউজকে বলেন, একজন পরিবেশবিদ হিসেবে কোনোভাবেই বিষয়টি মেনে নিতে পারছি না। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এ ধরনের গাছের উপকার বলে শেষ করা যাবে না। এতে অক্সিজেন কমবে এবং কার্বন ডাই অক্সাইড বেড়ে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে।
যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ছোলজার রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ফারাক্কা বাঁধের ধাক্কা, চুয়াডাঙা, ঝিনাইদহের যশোর অঞ্চলের মরুকরণ হতে রক্ষা করেছে যশোর বেনাপোল, যশোর-ঝিনাইদহসহ অন্য সড়ক-মহাসড়কের বনায়ন। একইসঙ্গে সামাজিক বনায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
তিনি বলেন, যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের ৩৮ কিলোমিটার সড়কের দু’পাশের গাছ প্রায় ৩৬ হাজার হেক্টর বনভূমির ভূমিকা পালন করছে। গাছগুলো ঘিরে জীববৈচিত্র্য গড়ে উঠেছে। এ অঞ্চলের পরিবেশের সুরক্ষার কবজ হিসেবে কাজ করছে গাছগুলো। মাত্র ৫ মিটার রাস্তা সম্প্রসারণে এতোগুলো গাছ একসঙ্গে কাটার সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী হবে।
জনউদ্যোগের আহ্বায়ক আরএম খায়রুল ইমাম বাংলানিউজকে বলেন, যশোরবাসী ঐতিহ্য রক্ষায় সোচ্চার নয়। এজন্য একে একে সব ঐতিহ্য ধ্বংস হচ্ছে। এরজন্য যশোরে সামাজিক নেতৃত্বেরও দুর্বলতা রয়েছে। আমাদের বহুমত, এক করা সম্ভব হয়নি বলেই আমরা বিভিন্ন সময়ে নানা উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছি।
যশোরের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হারুন অর রশিদ বলেন, গতবছর গাছ কাটার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। আমরা আন্দোলন করে বন্ধ করেছিলাম। আবার গাছ কাটার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। লুটপাটের স্বার্থে আমলাদের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিরাও গাছ কাটার সিদ্ধান্তে একমত হয়েছেন।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ১৮৪০ সালে জমিদার কালী পোদ্দারের মা ছায়ায় ছায়ায় গঙ্গাস্নানে যাবেন, এজন্য রাস্তার দু’পাশে তিনি বিদেশ থেকে অতি বর্ধনশীল রেইন্ট্রি বৃক্ষের চারা এনে রোপণ করেন। সেই বৃক্ষগুলোই যশোর বেনাপোল সড়কে এখনো ছায়া দিচ্ছে। দেশ ভাগের পর ৮০ কিলোমিটার যশোর রোডের ৩৮ কিলোমিটার পড়ে বাংলাদেশ অংশে। বাকি ৪২ কিলোমিটার পড়ে ভারতের অংশে পড়ে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বহু শরণার্থী এই মহাসড়ক পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল।
যশোর সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের ২১ মার্চ একনেকের সভায় ৩শ ২৮ কোটি ৯০ লাখ ৫৫ হাজার টাকা ব্যয়ে যশোর-বেনাপোল জাতীয় সড়কের (দড়াটানা-বেনাপোল পর্যন্ত) ৩৮ দশমিক ২ কিলোমিটার সড়ক যথাযথমানে প্রশস্তকরণ প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পের নকশা অনুযায়ী ‘মহাসড়কের প্রস্থ ৭ দশমিক ৩ মিটার থেকে বাড়িয়ে ১০ দশমিক ৩ মিটার করা হবে। একই সঙ্গে সড়কের উভয় পাশে ১মিটার করে মাটির জায়গা রাখা হবে। এতে সড়কের প্রস্থ দাঁড়াবে ১২ দশমিক ৩ মিটার। সব মিলিয়ে রাস্তার দু’পাশে পাঁচ মিটার সম্প্রসারণ করা হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে মহাসড়কের উভয় পাশের মোট ২ হাজার ৩১২টি গাছ কাটতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৮
ইউজি/এএ