ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ভিকটিম সাপোর্টে এনজিওদের অনীহা!

মানসুরা চামেলী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৪৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৮
ভিকটিম সাপোর্টে এনজিওদের অনীহা! ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার থেকে সহায়তাপ্রাপ্ত কয়েকজন নারী ও শিশু (ডিএমপির উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া ছবি)

ঢাকা: ছেলে বন্ধুর সঙ্গে রাজধানীতে এসে প্রতারণার স্বীকার হয় মৃদুলা (ছদ্মনাম)। নির্যাতনে বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থা নিয়ে রাজধানীর একটি থানায় আশ্রয় নেয়। এ অবস্থায় আত্মহননের পথ ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছে না মৃদুলা। থানা পুলিশ তার মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে ‘ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে’ নিয়ে যায়।
 
 

রাত তখন সাড়ে ১১টা। সাপোর্ট সেন্টারে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছেন মৃদুলাকে।

কিন্তু জীবনের ওপর বিতৃষ্ণা এসে যাওয়ায় মৃদুলা কেবল বারবার আত্মহত্যার কথা তুলছেন।  

এমন পরিস্থিতিতে ডাক্তারের সেবা ও মনোবল ফেরানোর কাউন্সেলিং দরকার বিধায় ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা চেষ্টা করছেন ডাক্তার আনার। কিন্তু কোনোভাবেই ফোনে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারছেন না ডাক্তারের সঙ্গে। আর কাউন্সেলিংয়ের দায়িত্বে যে বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) কর্মকর্তা, তিনিও ফোন ধরছেন না।  

এই অবস্থায় কী করণীয় ওই পুলিশ কর্মকর্তা বা ভিকটিমের? চুক্তিবদ্ধ এনজিওদের অসহযোগিতার কারণে এমনই পরিস্থিতিতে বারবার পড়তে হচ্ছে নির্যাতিতদের আলো ঠিকানা রাজধানীর তেজগাঁও ‘ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার’র কর্মকর্তাদের। মাঝেসাঝে এসে ফটো তুলে গেলেও সাপোর্ট সেন্টারের প্রয়োজনীয় সময় রাতেই পাওয়া যায় না এনজিওগুলোর কর্মকর্তাদের।

সাপোর্ট সেন্টার সূত্র জানায়, সাধারণত সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ঢাকা মহানগর এলাকার এই ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে আসে নির্যাতিতরা। কিন্তু এ ‘পিক আওয়ারেই’ তাদের সাপোর্ট দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকে না। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের সঙ্গে পুলিশের পাশাপাশি ১০টি এনজিও’র আইনি সহায়তাসহ অন্যান্য কাজের চুক্তি রয়েছে। চুক্তি অনুসারে, ভিকটিমকে আইনি সহায়তা, কাউন্সেলিং ও চিকিৎসা সেবা প্রদান করার কথা এনজিওগুলোর। তবে এনজিও’র কর্মকর্তারা ‘৯টা-৫টা’ ডিউটি করায় অভ্যস্ত হওয়ায় রাতেই তাদের পাওয়া যায় না। এমনকি বারবার ফোন করলেও ধরেন না।
 
এ কারণে যে ভিকটিমের কাউন্সেলিং ও চিকিৎসা সেবা দরকার, তার জন্য সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এভাবে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে উল্টো মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হতে হয়।

ডিএমপির উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের ওয়েবসাইটে চুক্তিবদ্ধ যে ১০ এনজিও’র নাম রয়েছে, সেগুলো হলো- আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), অ্যাসোসিয়েশন ফর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট, অ্যাসোসিয়েশন ফর কারেকশন অ্যান্ড সোশ্যাল রিক্লেমেশন, অপরাজেয় বাংলাদেশ, এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট, ঢাকা আহছানিয়া মিশন ও মেরি স্টোপস।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুরিশের (ডিএমপি) উপ-কমিশনার (উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন) ফরিদা ইয়াসমিন বাংলানিউজকে বলেন, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্ট‍ারে সন্ধ্যা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত নির্যাতিতরা আসে। অনেক সময় কেউ কেউ আত্মহত্যার কথা চিন্তা করে, তখন প্রয়োজন জরুরি কাউন্সেলিংয়ের। আবার অনেক নির্যাতিত শিশু আসে, তাৎক্ষণিক সেবার প্রয়োজন হয়, কিন্তু তখন ডাক্তার পাওয়া যায় না। এজন্য ভিকটিমকে সাপোর্ট দেওয়া চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে।  

ভিকটিমকে সহায়তা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়ার জন্য এনজিও সংস্থাগুলোকে দায়ী করে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আমরা পুলিশের পক্ষ থেকে ২৪ ঘণ্টা সেবা দিচ্ছি। রুটিন অনুসারে কাজ করা এনজিওগুলোর আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। জরুরি সময়ে ডেকে আনতে হয়। বারবার ফোন করেও পাওয়া যায় না।
সাপোর্ট সেন্টারের উপ কমিশনার ফরিদা ইয়াসমিন/ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
পারিবারিক সহিংসতায় নির্যাতিত নারী, যৌন নির্যাতনের শিকার নারী, আশ্রয়হীন গৃহকর্মী ও কমবয়সী নিখোঁজ শিশুরাই ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে আশ্রয় নিতে আসে। তেজগাঁও থানার অত্যন্ত পরিপাটি একটি দোতলা ভবনে তাদের আশ্রয়। একজন ভিকটিমের সর্বোচ্চ পাঁচ দিন পর্যন্ত থাকার ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। এরপর থাকতে হলে তাহলে তাকে এনজিওতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
 
একটি সূত্র জানায়, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের যে এনজিওগুলোর চুক্তি রয়েছে, তারা ‘সুদর্শন’ নারী ও শিশু খোঁজে। ‘কদাকার’ বা ‘দেখতে ভালো নয়’ ‌এমন নির্যাতিতদের নিতে চায় না তারা। কারণ, তারা সবসময় বরাদ্দের বিষয়ে চিন্তা করে। তারা মনে করে, একটি ‘ভালো মুখে’র ছবি বিদেশি অর্থদাতাদের দেখাতে পারলে আরও ভালো টাকা পাওয়া যাবে।
 
এনজিওগুলোর অসহযোগিতার বিষয়ে ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার চালাতে সরকার বছরে একটা বাজেট দেয়। সরকার থেকে নির্যাতিতদের পুর্নবাসন বা কাউন্সেলিং শেষে সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফের‍ার জন্য নগদ টাকা দেওয়া হয় না।  

তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, ‘ধরেন, কুড়িগ্রাম থেকে এক ভিকটিম এলো, এখানে অবস্থানের পর বা এনজিওগুলো থেকে রিকভারির পর সে যে বাড়িতে ফেরত যাবে, তার টাকা থাকে না। এমনকি বা-মায়ের কাছেও থাকে না। তখন আমাদের পুলিশ নিজের পকেট থেকে টিকিট কেটে পাঠিয়ে দেয়। ’  
 
ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, এনজিওগুলো ভিকটিম সেন্টারে আসে, ছবি তুলে চলে যায়। তাদের বিদেশি অর্থদাতাদের দেখায়, আমাদের সঙ্গে তারা আছে। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই তাদের অসযোগিতার মনোভাব রয়েছে। আমরা তাৎক্ষণিক অর্থ সাহায্যের জন্য পার্টনার এনজিওগুলোর সঙ্গে অনেকবার চুক্তি করার কথা বলেছি, তারা আশ্বাসও দিয়েছে, কিন্তু পরে আর আসেনি। ইসলামী ব্যাংকের সব ঠিকঠাক হয়েছিলো, পরে তারাও আর আসেনি।
 
২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার নির্যাতিত নারী ও শিশু ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে সহায়তা নিতে এসেছে। এদের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে তদন্তের মাধ্যমে ২০১১ থেকে ২০১৭ অক্টোবর পর্যন্ত ২ হাজার ৩৩৫টি মামলা হয়েছে।

বাংলাদেশে সময়: ০৫৩৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৮
এমসি/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।