সকালে যে মানুষটি কাজের উদ্দেশে বের হলো, পথেই যে যন্ত্রদানবের চাকায় পিষ্ট হয়ে তার জীবনটা এভাবে থমকে যাবে- এটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না বকরের স্বজনরা। থানা থেকে লাশ মর্গে যাবে কি-না! মামলা করলে বা না করলে কী লাভ হবে- এমন সব মৃদু আলোচনাতেই ঢাকা পড়ছিলো আহাজারি।
হুট করেই তখন থানায় ছুটে এলো একটি মাইক্রোবাস। বেশ যত্নের সঙ্গেই সেটায় তোলা হলো কালো কাপড়ের ব্যাগে মোড়ানো একটি হারমোনিয়াম।
একদিকে বকরের লাশ ঘিরে যেমন বিচ্ছেদের নীরব সুর। অন্যদিকে যেন বেঁচে থাকার সঙ্গীতে ঝংকার হয়ে হারমোনিয়ামের বেজে ওঠার প্রস্তুতি।
জীবনের কী বৈপরীত্য!
কিন্তু থানা থেকে হারমোনিয়াম যাচ্ছে কোথায়? কৌতুহলী প্রশ্নের সপাট উত্তর, ‘ক্যান জানেন না! আজ ওসি স্যার গান গাইবেন। ’ সেন্ট্রির দায়িত্বে থাকা এক কনস্টেবলের মুখেও যেন সুর উঠেছে। এভাবে সঙ্গীতের আগাম মূর্ছনায় থানাজুড়েই এক ভিন্ন আমেজ।
সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহসিনুল কাদির কেবল পুলিশ কর্তাই নন, আপাদমস্তক কবি, গায়ক, সুরকার ও গীতিকার। স্থানীয়ভাবে গানের আসর বসলেই ডাক পড়ে তার। প্রমাণ মিললো ওসির কক্ষেও। সামনে থাকা টেবিলে একগাদা খবরের কাগজ। তার মাঝে বেশ কয়েকটি কাগজে কম্পোজ করা গান। একটিতে বশীর আহমেদের ‘অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায়’, আরেকটিতে গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা, সত্য সাহার সুর করা ও খন্দকার ফারুক আহমেদের গাওয়া ‘নীল আকাশের নিচে আমি রাস্তা চলেছি একা’ এবং আরেকটি কাগজে শ্যামল মিত্রের ‘ভ্রমরা ফুলের বনে মধু নিতে অনেক কাঁটার জ্বালা’ গানটি।
একবার কাগজে চোখের পলক পড়ে তো, ঠোঁটে গুনগুনিয়ে ওঠে সেসব গান। এরই মাঝে সেবাগ্রহীতাদের আবার সামলাচ্ছেন ওসি। বেশ খোশমেজাজেই। একটি ফোন না ছাড়তেই আরেকটি বেজে উঠছে। ওসি দু’টি ফোনই দু’কানে নিয়ে সামলাচ্ছেন একসঙ্গে।
‘ঠিকই ধরেছেন। আজ আমি গান গাইবো। গলাটা উশখুশ করছে। যা ঠাণ্ডা না! তবু চেষ্টা করবো ভালো গাইতে। ’ বলছিলেন ওসি মহসিনুল কাদির।
তো কবে থেকে সঙ্গীতের এ প্রতিভা? ওসি বলেন, ‘এটা তো ছেলেবেলা থেকেই। আমার পরিবারই সঙ্গীতের বেশ সমঝদার। ছেলেবেলায় বাড়িতে সঙ্গীত চর্চা হতো। সেখান থেকেই রক্তে সঙ্গীত। স্কুল জীবনে তো নিজেই পাড়ার মঞ্চ কাঁপাতাম। তারপর নানা কারণে গান হারিয়ে গেলো। আবার ফিরেও এসেছে। ’
‘তবে আমার গান নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই। তা সত্ত্বেও গাই। সেটা মনের তাগিদে। মানুষ হাততালি দেয়। আমিও খুশি হই। অনুপ্রেরণ পাই। ’ বলছিলেন পুলিশের ৯২ ব্যাচের এই কর্মকর্তা।
তো গান গেয়ে হাততালি ছাড়া আর কিছু পাননি কখনো? ‘পাই তো। একজন আমার গান শুনে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দিয়েছেন। ’
সেটা কি সঙ্গীত প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে? মহসিনুল কাদির উত্তর দেন, ‘জানি না। প্রকৃতপক্ষে গান শুনে, না-কি ওসি গান গেয়েছে বিধায় খাতির রাখলে কাজে দেবে- এমনটা ভেবে বখশিস দিয়েছে তা নিশ্চিত নই। এখানে সঙ্গীত প্রতিভা নিয়ে আসলে আমার আত্মতুষ্টির কিছু নেই। আবার ধরেন গানের শেষে হাততালি। সেটাও হয়তো মনে করে, ওসি গাইছে। একটু হাততালি দিই। এই আর কী!’
‘এর মাঝে কিন্তু আবার ব্যতিক্রমও আছে। পুলিশ লাইনসের একজন রিজার্ভ ইন্সপেক্টর আছেন। তিনি তো আমার গানের মহাভক্ত। গান গাইলে ৩-৪ হাজার টাকা দেন। তাকে তাই মাঝে মাঝে বলি, আপনার মতো আমার গানের সমঝদার থাকলে তো বখশিস দিয়েই মাসে ২-৩ লাখ টাকা আয় হতো। তবে বাস্তবতা তো অন্যরকম। ’ স্মিত হেসে ওসির উত্তর।
শ্রোতা-দর্শকদের মনোভাব নিয়েও মহসিনুল কাদিরের বেশ অভিজ্ঞতা, ‘ভদ্রলোকের প্রোগ্রামে গান গাইলে হাততালি ছাড়া কোন বখশিস মেলে না। কারণ ওরা দিতে জানে না। ওদের হৃদয় থাকে সংকুচিত। কিন্তু সাধারণ মানুষ যেভাবে গান শুনে এগিয়ে আসে, হাততালি দেয়, বখশিস দেয়, প্রতিবারই নতুন করে গান গাইবার প্রেরণা পাই। ’
কেবল গান গেয়ে মঞ্চ মাতানোই নয়, শিল্প-সাহিত্যের অনুরাগী হিসেবেও ভিন্ন পরিচিতি রয়েছে মহসিনুল কাদিরের।
বাসার বইয়ের তাকে সাজানো গাদা গাদা বই। আবার থানায় আইনের বইয়ের ফাঁকেও প্রাচীন ইতিহাস, ধর্ম, ঐতিহ্য, রাজনীতির বিষয়ে নানা ধরনের বই।
এগুলো পড়ার সুযোগ পান কখন? ‘ভাইরে আগে চাকরি। পেশাদারিত্ব ঠিক রেখে তবেই শিল্পচর্চা। তবে সঙ্গীত এতো সহজ বিষয় নয়। অনেক সাধনার। আমি তো শিল্পী নই। প্রকৃত শিল্পী হওয়া অনেক কঠিন। ’
সম্প্রতি ওসিকে একটি বেসরকারি চ্যানেলের শিল্প-সাহিত্যের আসরে কবি নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে কবিতা পাঠ করতেও দেখা যায়।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নানা ভাবনা থেকে কবিতা আসে। তার মাঝে সুর দিয়ে কিছু গানও লিখি। বাদ্যযন্ত্রের ঝংকারে সেটা যখন প্রাণ প্রায়, তখন সত্যিই ভালো লাগে। ’
সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে ওসি নিজের পরিচিতির ব্যাপারেও বেশ সংরক্ষণশীল। সলাজ ভঙ্গিতে মুখ ঢেকে বলেন, ‘আমি আগে পুলিশ অফিসার। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করাটাই আমার প্রধান দায়িত্ব। আমার হাত ধরে উন্নতি হয়েছে এলাকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। ’
একটি অপ্রিয় প্রশ্ন! থানার সঙ্গে তো বেতন-বহির্ভূত আয়-রোজগারের বিষয়টিও আলোচিত। শিল্প সাহিত্যের সঙ্গে ঘুষ দেওয়া-নেওয়াটাও কি কখনো সাংঘর্ষিক মনে হয় না!
ওসির উত্তর, ‘দেখুন আমি তো মানুষ। নিজেকে বলা যাবে না আমি পুরোপুরি ভালো একজন মানুষ। তবে আমি একটু আলাদা। এর আগে গাজীপুরের শ্রীপুরে। তারপর ঢাকার আশুলিয়া হয়ে এখন সাভার মডেল থানায় ওসির দায়িত্ব পালন করছি। এমন কেউ বলতে পারবে না, আমি কারও সঙ্গে জলুম করেছি। টাকা নিয়েছি। আর সেটা করলে ওসির ভাবমূর্তি থাকে না। থানা চালাতে যে সাহস লাগে সেটাও কিন্তু থাকে না। ’
‘তবে হ্যাঁ, আমি অত্যন্ত সংবেদনশীল একজন মানুষ। মানুষের উপকার করাটাই আমার নেশা। নিজেকে কখনোই অনিয়ন্ত্রিতভাবে চালিত করি না। আর মানুষকে ফাঁসিয়ে ফায়দা হাসিল করা নয়, তাদের উপকার করাটাই থাকে আমার ব্রত। ’ বলেন ওসি।
‘কই রে! আমার হারমনিয়াম কই!’ হাঁক ডেকেই বললেন, ‘অনেক কথা বললাম। আজ ঢাকা জেলার মিল ব্যারাক পুলিশ লাইনসে্ বিদায়ী আইজিপি একেএম শহীদুল হক স্যারের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতা, পেশাজীবী ও সুধীসমাজের মতবিনিয়ম সভার আয়োজন রয়েছে। সাংস্কৃতিক আয়োজনে আমি গান গাইবো। দোয়া করবেন। ’
‘কই রে আমার লবঙ্গ মেশানো গরম পানি?’ বডিগার্ডের হাতে ধরা ফ্লাক্স দেখেই স্বস্তিতে গাড়িতে ওঠেন ওসি মহসিনুল কাদির।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০১৮
এইচএ/