বিদায়লগ্নে ‘বিনম্র বিষন্নতায়’ বাংলানিউজকে এমনটিই বলছিলেন বাংলাদেশ পুলিশের বিদায়ী মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক।
মাত্র একদিন বাদেই সুদীর্ঘ ৩২ বছরের কর্মজীবনকে বিদায় জানিয়ে অবসরে যাবেন শরীয়তপুরের নড়িয়া থানার নরকলিকাতা গ্রামের সন্তান শহীদুল হক।
‘আপনাকে নিয়ে তো নানা গুঞ্জন। কেউ বলছেন রাষ্ট্রপতির কোটায় আপনাকে সচিব করা হতে পারে। কেউবা আবার বলছে, রাষ্ট্রদূত করে দেশের বাইরেও পাঠানো হতে পারে। যেমনটি হয়েছিলো বাংলাদেশের ইতিহাসে পুলিশ প্রধান পদে সর্বোচ্চ সময় দায়িত্ব পালনের রেকর্ড গড়ে যাওয়া হাসান মাহমুদ খন্দকারের ক্ষেত্রে। অবসরোত্তর ছুটি (পিআরএল) বাতিলের শর্তে তিন বছরের চু্ক্তিতে বর্তমানে স্পেনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করছেন হাসান মাহমুদ খন্দকার। সেই প্রেক্ষিতে এমন কোনো সম্ভাবনা!’‘না না। সত্যিই এসব বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। প্রকৃতপক্ষে খোদাই জানেন আমার ভাগ্যে কী লিখে রেখেছেন’। বলছিলেন বিদায়ী আইজিপি শহীদুল হক।
২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে সেই দিনটিই যেন ফিরে এসেছে। সেদিন বেশ আনন্দ আর উৎসাহে পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব নিয়েছিলেন শহীদুল হক। বিদায়ের বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন ছিলেন হাসান মাহমুদ খন্দকার। এখন উল্টোচিত্র। সবার উৎসবের ঢেউ যেন নবনিযুক্ত আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীকে ঘিরে।
তবে ব্যতিক্রমও যে আছে, তা আবার প্রমাণ করে দিয়ে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দিলো ঢাকা জেলা পুলিশ। সেই আয়োজনেই আপ্লুত হলেন বিদায়ী আইজিপি শহীদুল হক। স্রোতের বিপরীতে গিয়ে ঢাকা জেলা পুলিশ প্রশাসন ভিন্নভাবে সম্মানিত করলো বিদায়ী আইজিপিকে।
‘আসলেই এটা যে ওদের কতো বড় উদারতা। আমাকে এভাবে সম্মান জানিয়ে ওরা নিজেদের মহৎ হিসেবেই প্রমাণ করেছে। ’ আয়োজন নিয়ে বাংলানিউজকে বলছিলেন শহীদুল হক।
শহীদুল হক এক অর্থে সূর্যাস্তের তারা। বিপরীতে ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীকে ঘিরেই পুলিশের আকাশে উঠছে নতুন সূর্য। সবাই তাকিয়ে যেন সেদিকেই।
সুধী সমাবেশ আয়োজন করে ঢাকা জেলা পুলিশ সোমবার (২৯ জানুয়ারি) রাতে ঢাকার মিলব্যারাকে ব্যতিক্রমী বিদায় জানিয়েছে বিদায়ী আইজিপিকে। বিদায়টা বরাবরই হয় বিষণ্ন। তবে আকাশে আতশবাজি, সেরা শিল্পীদের নাচ আর গানের মূর্ছনায় ঢাকা পড়েনি সেই বিষাদ।
যেটি বরাবরই ছিলো বিদায়ী আইজিপি এ কে এম শহীদুল হককে ঘিরে।
মঞ্চে নিজের কর্মজীবনের সাফল্যে অনুজদের বক্তব্যে যখন মুহুর্মুহু করতালি, তখনো যেন নির্বাক দর্শক এ কে এম শহীদুল হক।
খুবই শান্ত। কখনো উদাস, কখনো আনমনা বা ভারাক্রান্ত হৃদয়, কখনোবা মোবাইল ফোন নিয়েই ব্যস্ততায় কাটিয়ে দিলেন তিনি।
কী লিখছিলেন মোবাইল ফোনের ক্ষুদে বার্তায়? নিজের নম্বর দিয়ে পরিচিতিজনকে লিখে পাঠাচ্ছিলেন, ‘Assalamualaikum. After completion of 32 years service in police department I am going into retirement on 31 January 2018. I recall your valued cooperation and support with highest gratitude to the success of my efforts and duty. Plz keep my family and me in your prayers. I will be using the following cell number:
017########AKM Shahidul Hoque
Inspector General
Bangladesh Police। ’
যখন কোনো আলোকচিত্রী তার সামনে, তখন কেবলই নড়েচড়ে বসছিলেন। ডাক পড়লো মঞ্চে। বক্তব্যে স্মরণ করিয়ে দিলেন আন্দোলনের নামে বিভীষিকার দিনগুলোর কথা। ‘পরাজিত শক্তি, মানবতাবিরোধীরা দেশজুড়ে অরাজকতা সৃষ্টি করলো। তারা নিজেদের নেত্রীর সঙ্গে দেখা করে আসার পর পরই বক্তব্য দিতো আর একটি ঘটনা ঘটতো। আমাকে তখন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হলো। বললাম, যারা নেত্রীর সঙ্গে দেখা করে আসবে, তাদের সবাইকে আসামি করে মামলা দিতে। এটা ছিলো আমার কৌশল। একে একে রুই-কাতলারা ধরা পড়লো। কোনো উপায় ছিলো না। ’
বিদায়ী আইজিপি বলে চলেন, ‘এরপর এলো জঙ্গি তৎপরতা। হলি আর্টিজান, শোলাকিয়ার ঘটনায় দেশজুড়ে আতংক সৃষ্টি হলো। বিদেশি ক্রেতারা দেশে আসতো না। কূটনীতিকরা তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শংকায় পড়লো। অনেকে নিজেদের ছেলে-মেয়েদের বিদেশে পাঠাচ্ছিলো। দেশে বিনিয়োগ হচ্ছিলো না। সেই পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে দেশকে রক্ষা করতে পেরেছি। জঙ্গিদের আস্তানা একটি একটি করে খুঁজে বের করেছি। ঘটনা ঘটানোর আগেই আমরা তাদের প্রতিহত করেছি। আমাদের এ অভিযানে সেনাবাহিনী, পুলিশের কর্মকর্তারা আত্মাহুতি দিলেন। সেদিক থেকে আমাদের যথেষ্ট ত্যাগ রয়েছে। ’
শহীদুল হক তার দায়িত্ব পালনকালের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘বিএনপির নির্বাচন বানচালের চেষ্টার দিনগুলোতে পুলিশের মনোবল ঠিক রাখতে নিজে প্রত্যেক পুলিশ সুপারকে ফোন দিয়েছি। বলেছি, সাহস নিয়ে কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর হতে, দ্বিধান্বিত হওয়া যাবে না। কারণ লক্ষ্য ছিলো একটাই, গণতন্ত্র আর সাংবিধানিক ধারাবাহিকতাকে ঠিক রাখতে হবে। ইলেকশন না হলে দেশে অগণতান্ত্রিক শক্তি আসতো। সেদিন জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা গণতন্ত্রকে রক্ষা করেছিলাম। যে আস্থা নিয়ে আমাকে আইজিপি করা হয়েছিলো, আমি আমার আন্তরিকতা আর প্রতিভা দিয়ে তা বজায় রাখার চেষ্টা করেছি। কতটুকু পেরেছি তার মূল্যায়ন করবে দেশের মানুষ। ’
জনগণের কাছে মূল্যায়ন, জবাবদিহি ও তাদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে বিদায়ী আইজিপি বলেন, ‘যে উচ্চতায় পুলিশকে তুলে ধরেছি, তা যেন বজায় রাখা হয়। ’
শহীদুল হকের বর্ণিল কর্মজীবন যখন প্রোজেক্টরের রঙিন পর্দায় তুলে ধরা হচ্ছিলো, স্মৃতির ভেলায় ভেসে তখন যেন আপ্লুত তার দু’টি চোখ।
সঙ্গে সহধর্মিনী শামছুন্নাহার রহমান। আকাশে আতশবাজি, নাচ-গান। বর্ণিল এমনসব আয়োজনের পরও যেন বিষণ্নতা কাটছিলই না তার।
‘এই মুহূর্তগুলো আসলেই খুবই কষ্টকর। তিন দশকের কত্তো স্মৃতি। শীর্ষপদ থেকে সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চেনা মানুষের অচেনা রূপ। গাড়ির পেছনে গাড়ির বহর বা প্রটোকলের অনুপস্থিতি কিংবা মিডিয়ার মনোযোগে না থাকা! –সত্যিই মুহূর্তগুলো মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়। ’ স্মৃতি হাতড়ে বলছিলেন উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) থেকে অবসরে যাওয়া একজন জাঁদরেল কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০১৮
এইচএ/