ভ্যাটিকান সিটি সফররত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) সকালে দেশটির রাষ্ট্রপ্রধান ও পোপ ফ্রান্সিস এবং পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কার্দিনাল পিয়েত্রো পারোলিন বৈঠক হয়। দু’টি বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুটি গুরুত্ব পায়।
পরে বৈঠক দু’টির আলোচনার বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক ও ভ্যাটিক্যানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শামীম আহসান সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
পোপ ফ্রান্সিসের আমন্ত্রণে ভ্যাটিকান সফরে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী প্রথমেই ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের সর্বোচ্চ এই ধর্মগুরুর সঙ্গে বৈঠক করেন।
পোপের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি তুলে ধরে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, পোপের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘ আলোচনায় মিয়ানমারের ১ মিলিয়নের (১০ লাখ) বেশি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু আশ্রয় দেওয়ার কথা উঠে এসেছে। এই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর ভূয়সী প্রশংসা করেন পোপ।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, পোপ প্রধানমন্ত্রীর কাছে রোহিঙ্গা সংকটের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। প্রত্যাবাসন কিভাবে হবে, কিভাবে প্রত্যাবাসন নিরাপদ ও টেকসই হবে, সে বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীও পোপকে রোহিঙ্গা সংকট ও এর সমাধানের বিষয়ে বলেন।
গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে পোপের বাংলাদেশ সফরের কথা উল্লেখ করে শহীদুল হক বলেন, পোপ বাংলাদেশে বিদ্যমান ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রশংসা করেছেন। সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কে খুব ভালো এবং উঁচু মানের ধারণা তৈরি হয়েছে তার।
পোপের সঙ্গে বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হয় ভ্যাটিকান সিটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী কার্দিনাল পিয়েত্রো পারোলিনের।
এ বৈঠকের বিষয় তুলে ধরে রাষ্ট্রদূত শামীম আহসান বলেন, কার্দিনাল পেয়েত্রো রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থানের প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকট প্রথম থেকে বাংলাদেশ যেভাবে মোকাবেলা করছে, তা সারাবিশ্বের জন্য অনুকরণীয়।
শামীম আহসান জানান, পারোলিন রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী তাকে বলেন, ‘আমরা মনে করি সমস্যাটি ওই পাশে সৃষ্টি, ওখানেই তার সমাধান আছে। সে কারণে আমরা তাদের সঙ্গে যে চুক্তি করেছি, সেই চুক্তিকে বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের দায়িত্ব অনেক বেশি। তাদের কাছ থেকে আমরা সেভাবে সাড়া এখনো পাইনি। ’
রাষ্ট্রদূত জানান, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘প্রক্রিয়াটা শুরু করতে হবে। ওখানে সে অবস্থা সৃষ্টি করতে হবে, যে অবস্থা সৃষ্টি করলে রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে চাইবে, সে দায়-দায়িত্ব মিয়ানমারের’।
শামীম আহসান বলেন, এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে দেওয়া পাঁচটি প্রস্তাব ও কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের দাবির কথা বলেন। সেগুলো এখনও মিয়ানমার সরকার বাস্তবায়ন করছে না বলেও প্রধানমন্ত্রী জানান।
রাষ্ট্রদূত বলেন, প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে ভ্যাটিকান সিটি ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অনুরোধ করেন মিয়ানমারের ওপর চাপ রাখতে, যেন এ সমস্যা সমাধানে তারা বাধ্য হয়।
পারোলিন উগ্রবাদ মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন বলে জানান শামীম আহসান।
তিনি বলেন, পারোলিন বলেছেন, ‘পৃথিবীর প্রায় সবদেশে এখন কম-বেশি গোঁড়া মানসিকতার মানুষের কার্যক্রম আছে। আমরা মনে করছি বা যা দেখছি, বাংলাদেশে আপনারা এটা খুব ভালো মোকাবেলা করেছেন। সেটা এখন কী অবস্থায় আছে, জানতে চান পিয়েত্রো পারোলিন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমি প্রথম থেকে মনে করি ধর্মে মানুষ হত্যার পেছনে কোনো কারণ থাকতে পারে না। বাংলাদেশের মাটিতে কখনো কোনো দেশের বিরুদ্ধে কোনো চরমপন্থি কার্যক্রম বরদাশত করা হবে না। এটা আমি নিজেদের দেশের জন্য বলেছি, আশপাশের প্রতিবেশী দেশের জন্যও বলেছি। আমরা সেভাবে কাজ করে যাচ্ছি। ’
ভ্যাটিকানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘২০১৬ সালে একটি ঘটনা ঘটেছে। তারপর থেকে আমরা অনেক বেশি সচেতন হয়েছি। ’ বিভিন্ন উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাংলাদেশের কোথাও এখন আর তাদের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম নেই। ’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মানুষ যদি তাদের (সন্ত্রাসী-উগ্রবাদী) সহযোগিতা না করে তবে তারা তাদের কার্যক্রম চালাতে পারে না। আমি আমার মানুষকে বলেছি, এদের কোনো সহযোগিতা করবে না। মানুষ তাই করছে। সেজন্য আমরা জনগণের কাছ থেকেই খবর পাই, কারা কোথায় কী করতে চাইছে। ’
জবাবে পিয়েত্রো পারোলিন বলেছেন, ‘এটাই সঠিক পথ এ সমস্যা মোকাবেলার। বাংলাদেশ এটা খুব ভালোভাবে করছে। ’
জাতিসংঘের কৃষি উন্নয়ন তহবিলের (আইএফএডি) প্রেসিডেন্ট গিলবার্ট এফ হিউংবোর আমন্ত্রণে ইতালির রোমে গভর্নিং কাউন্সিলের সভায় অংশ নিতে এবং পোপ ফ্রান্সিসের ভ্যাটিকান সফরের আমন্ত্রণে চার দিনের সরকারি সফরে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
ঢাকা থেকে রোম যাওয়ার পর সোমবার সকালে (স্থানীয় সময়) সেখান থেকে ভ্যাটিকান সিটিতে যান শেখ হাসিনা। সকাল ১০টায় ভ্যাটিকান সিটিতে পৌঁছালে প্রধানমন্ত্রীকে স্ট্যাটিক গার্ড অব অনার দেওয়া হয়।
পোপের সঙ্গে বৈঠকের সময় বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে আঁকা একটি শিল্পকর্ম তাকে উপহার দেন শেখ হাসিনা। পোপও একটি ক্রেস্ট দেন প্রধানমন্ত্রীকে।
পরে প্রধানমন্ত্রী সিস্টিন চ্যাপেল ও সেন্ট পিটারস বাসিলিকা গির্জা পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী।
পোপের সরকারি বাসভবন সিস্টিন চ্যাপেল হচ্ছে ভ্যাটিকান সিটির এমন এক প্রাসাদ, যেখান থেকে পোপ তার যাবতীয় ধর্মীয় এবং আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম সম্পন্ন করেন। অন্যদিকে সেন্ট পিটারস বাসিলিকা হচ্ছে ইতালির রেঁনেসার স্মারক এক ঐতিহ্যবাহী গির্জা।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী রোমে যে হোটেলে থাকছেন, সন্ধ্যায় সেখানে সঙ্গে তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (ডব্লিউএফও) নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিয়াসলি।
এর আগে রোববার (১১ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় সফরসঙ্গীদের নিয়ে রোমের লিউনার্দো দ্য ভিঞ্চি মিউমিচিনো বিমানবন্দরে পৌঁছান শেখ হাসিনা। তিনি ১৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় দেশে ফিরবেন।
বাংলাদেশ সময়: ০১০৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৮
এমইউএম/এইচএ/
** পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ
** সব ধর্মের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে পোপের প্রশংসা