ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে ৩৫ কোটি টাকার টেন্ডার

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫১৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৮
সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে ৩৫ কোটি টাকার টেন্ডার

লক্ষ্মীপুর: বর্তমান সরকারের চলতি মেয়াদের শেষ সময়ে এসে লক্ষ্মীপুরে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ সিন্ডিকেট বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে নিয়ম রক্ষার টেন্ডার দাখিল করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন সিন্ডিকেট সদস্যরা।

সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) লক্ষ্মীপুর গণপূর্ত অধিদপ্তরের একটি উন্নয়ন প্রকল্পের ৩৫ কোটি টাকার টেন্ডারে পাহারা বসিয়ে কাজ পাইয়ে দিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে। এভাবে চলতে থাকায় রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার, কাজ হচ্ছে নিম্নমানের।

এদিকে, ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে বেড়েছে অসন্তোষ। অব্যাহত টেন্ডার নিয়ন্ত্রণের কারণে সাধারণ ঠিকাদারদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। খুনোখুনির জনপদ হিসেবে খ্যাত লক্ষ্মীপুরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কমলেও বেড়েছে টেন্ডার সন্ত্রাস।

জানা যায়, গেলো বছরের ১৪ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালকে ১০০ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীতকরণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তা বাস্তবায়নে গণপূর্ত বিভাগ ৩৫ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বান করে। দরপত্র দাখিলের শেষ দিন ছিল ১২ ফেব্রুয়ারি। এর আগে কাজটি নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতা জেলা শহরের একটি রেস্তোরাঁয় বৈঠক করেন। বৈঠকে নোয়াখালীর এক প্রভাবশালী নেতা, জেলা যুবলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সাধারণ সম্পাদক, রায়পুর উপজেলা আহ্বায়কসহ কয়েকজন নেতা অংশ নেন।

ওই বৈঠকে ৩৫ কোটি টাকার দুই পার্সেন্ট করে দেওয়ার শর্তে নোয়াখালীর এক ঠিকাদারকে কাজটি পাইয়ে দেওয়ার সিদ্দান্ত হয়। অন্য ঠিকাদাররা দরপত্র দাখিল করতে যেন না পারেন সেজন্য আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ওই নেতারা লক্ষ্মীপুর গণপূর্ত কার্যালয়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও নোয়াখালীতে পাহারা বসান বলে একাধিক সূত্রে জানা যায়। এতে করে ভয়ে সাধারণ ঠিকাদাররা দরপত্র জমা দিতে পারেননি বলেও জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট দপ্তর সূত্রে আরো জানা যায়, ওই কাজের জন্য দরপত্র বিক্রি হয়েছে ২০টি। এর মধ্যে নোয়াখালীতে দুটি ও লক্ষ্মীপুরে একটিসহ জমা পড়েছে মাত্র তিনটি। নিয়ম রক্ষার জন্য মেসার্স এম এম বিল্ডার্স, রূপালী জি এম সন্স কনসোর্টিয়াম, ন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ডেভেলেপমেন্ট লিমিটেডের নামে কৌশলে ৩টি পাতানো দরপত্র দাখিল করা হয়।

লক্ষ্মীপুর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আব্দুর ছাত্তার বলেন, কার্যালয়ের ভেতরে কোনকিছু ঘটেনি। বাইরে কী হয়েছে না হয়েছে সেটি আমার দেখার বিষয় না। দরপত্রগুলো চট্টগ্রাম মূল্যায়ন কমিটি যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী জানান, শীর্ষ নেতাদের মধ্যে ৫/৬ জন সিন্ডিকেট করে একের পর এক টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। দলের নাম বিক্রি করে ভাগ-বাটোয়ারায় নিজেদের পকেট ভরছেন তারা। সর্বশেষ গণপূর্তের ৩৫ কোটি টাকার টেন্ডার দলের নামে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা সকল সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছেন। আগামী নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে বলেও মনে করেন তারা।

এ ব্যাপারে জানতে জেলা যুবলীগের সভাপতি এ কে এম সালাহ্ উদ্দিন টিপু ও জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাকিব হোসেন লোটাসের মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও তাদের বক্তব্য জানা যায়নি। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি চৌধুরী মাহমুদুন্নবী সোহেল কিছুই জানেন না বলে জানান।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন জানান, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবহিত নন। টেন্ডার সন্ত্রাসের সঙ্গে তিনি ও আওয়ামী লীগ জড়িত নন বলে দাবি করেন তিনি।

এদিকে গণপূর্তের এ টেন্ডারের মতো সাম্প্রতিক সময়ে সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ২ কোটি ২০ লাখ টাকা, রামগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ে প্রায় কোটি টাকা ও শিক্ষা প্রকৌশলী অধিদপ্তরে কোটি টাকার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করার অভিযোগ রয়েছে।  

এছাড়া গেলো এক বছরে নানা কূটকৌশলে সড়ক ও জনপদ বিভাগ, এলজিইডি, জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য বিভাগ ও জেলার ৪টি পৌরসভায় শত কোটি টাকার টেন্ডার সিন্ডিকেটটি নিয়ন্ত্রণ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব টেন্ডার নিয়ে নিজেদের মধ্যে হাতাহাতি ও মামলার ঘটনাও ঘটেছে।

কয়েকজন ঠিকাদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকারের কোষাগারে প্রতিবছরই নির্ধারিত টাকা দিয়ে প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়ন করি। কিন্তু সন্ত্রাসের কারণে কোনো টেন্ডারে অংশ নেওয়া যাচ্ছে না। মতলববাজদের রক্তচক্ষু ও তাদের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার চাইতে টেন্ডারে অংশ না নেওয়াই ভালো বলে মন্তব্য করেন ওই ঠিকাদাররা।

কেউ কেউ অভিযোগ করেন, অফিস খরচ, রাজনৈতিক নেতাদের পার্সেন্টেজ দিয়ে কাজ করতে গিয়ে বাধ্য হয়ে নিম্নমানের কাজ করতে হয়। এতে করে উন্নয়ন কাজে গলদে ভরপুর থাকে।

এদিকে এমন পরিস্থিতিতে সচেতন মহল মনে করছেন উন্নয়নের নেত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান সরকারের আমলে লক্ষ্মীপুরে খুনোখুনি কমলেও টেন্ডার সন্ত্রাস বেড়েই চলছে। এখনি তা বন্ধ করা না হলে আগামী সংসদ নির্বাচনে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।

বাংলাদেশ সময়: ১১১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৮
এসআর/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।