তখন ২০০৬ সাল। শেষ বার যখন অপহৃত হয়েছিলেন, মুক্তিপণ দিয়ে ফেরার পর অর্থাভাবে আর ব্যবসা দাঁড় করাতে পারেননি তিনি।
কখনও প্রতিদ্বন্দ্বী বনদস্যু বাহিনীর সঙ্গে, কখনও বা পুলিশ, কোস্টগার্ড বা র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন কয়েকবার। মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে পরিবার-পরিজনহীন নিঃসঙ্গতায় কেটেছে ১০টি বছর।
কিন্তু এখন ফিরেছেন স্বাভাবিক জীবনে!
বলছি, সুন্দরবনের ত্রাস নামে পরিচিত, সদ্য আত্মসমর্পণকারী বনদস্যু মজনু বাহিনীর প্রধান মজনু গাজীর কথা।
আত্মসমর্পণের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া অনুদান নিয়ে নতুন জীবন যুদ্ধে নেমেছেন মজনু গাজীসহ আত্মসমর্পণকারী অন্যান্য বনদুস্যরা।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়নের মৌখালীতে চুনা নদীর চরে গড়ে তুলেছেন শুটকির খুটি (শুটকি পল্লী)।
বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় দস্যু জীবনের নানা ঘটনা তুলে ধরে মজনু গাজী বলেন, এখন অনেক ভালো আছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে এভাবে আমাদের দায়িত্ব নেবেন তা ভাবলেই চোখে পানি এসে যায়। অন্য কেউ হলে দায়িত্ব নিতো না।
তিনি বলেন, আমার দলে ৪০-৪২ জন ছিল। অস্ত্র ছিল ৬০-৬৫টি। দস্যু জীবনে বনদস্যু হাফিজ, নুর হবি, খয়লার, পুলিশ ও কোস্টগার্ডের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে কখনও জিতেছি, কখনও বা কেউ জেতেনি। ২০০৮ সালে একবার সুন্দরবনের নিশানখালীতে সম্মুখ যুদ্ধে আমার হাতে ও গলায় গুলি লাগলো। যদিও সেবার আমরাই জিতেছিলাম। ২০১৪ সালের দিকে যখন র্যাবের তৎপরতা বেড়ে যায়, মৃত্যু ভয়ে তখন ভারতে আত্মগোপন করি। তখন ভাবতাম বেশিদিন বোধ হয় বাঁচবো না। ভারতে ১৫০ কোটি মানুষ ছিল। কিন্তু আমার আপন কেউ ছিল না। তারপর আবার যখন বনে ফিরি, তখনই সাংবাদিক মোহসিনুল হাকিমের কাছ থেকে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাই। কিন্তু ভয় করতো, তিনি কি আসলেই আত্মসমর্পণ করিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দিতে পারবেন? না কি মরতে হবে। কিন্তু না, তিনি কথা দিয়ে কথা রেখেছেন। এখন আমার দেশের মাটিতে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারি। পরিবার পরিজন নিয়ে ১০০ বছর বাঁচতে ইচ্ছে করে।
তিনি বলেন, পরিস্থিতির শিকার হয়ে দস্যু জীবনে প্রবেশ করলেও সবসময় চাইতাম স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে। কিন্তু চাইলেই কি সব সম্ভব? অপেক্ষার প্রহর গোনা শেষ হয় ২০১৬ সালে। মোংলায় আনুষ্ঠানিকভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন আট মাস জেলে ছিলাম। তারপর জামিন পেলে সরকার প্রত্যেককে এক লাখ ৭০ হাজার টাকা করে অনুদান দেয়। অনুদানের টাকা পেয়ে আমি, আমার দলের এনামুল, বাবু ও খোকন চিন্তা করতে থাকি কী করা যায়। তারপর চারজনের টাকা দিয়ে শুরু করলাম শুটকির প্রজেক্ট। এখন আমাদের শুটকির খুটিতে আটজন কর্মচারী কাজ করছে। জেলে রয়েছেন ৫০-৬০ জন। যাদের দাদন দিয়ে মাছ কেনা হয়। আর সে মাছ শুকিয়ে পাঠানো হয় চট্টগ্রামে। কাঁচা কিছু মাছ যায় খুলনায়। পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালোই আছি আমরা।
সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে মজনু গাজী বলেন, আত্মসমর্পণের পরও মামলা চালানোর সক্ষমতা না থাকায় এখনো অনেক দস্যু জেলে রয়েছেন। সরকারের কাছে দাবি, তাদের মামলার বিষয়টি দেখুন। সুযোগ দিন প্রাণ ভরে মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার।
শুধু মজনু গাজী নয়, একইভাবে নতুন জীবনে ফিরে সরকারের দেওয়া অনুদান দিয়ে কেনা ইজিবাইক চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন বনদুস্য আলম বাহিনীর প্রধান আলম ও খোকা বাবু বাহিনীর সদস্য কামরুল। অ্যালবেস্টারের দোকান দিয়েছেন আলিফ বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড সিরাজুল। সবাই যেন এক নতুন জীবনের খোঁজে!
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৮
এসআই