শুক্রবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) বিকেল ৩টার দিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভা কক্ষে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এ তালিকা দেওয়া হয়। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন বিষয়ে বিকেল ৩টার দিকে এ বৈঠক শুরু হয়।
বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পাসপোর্ট অফিস ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রায় ১১ লাখ মানুষের একটি তালিকা করেছে। মিয়ানমার বলেছিল, পরিবার ও এলাকাভিত্তিক তালিকা দিতে। তাদের চাহিদা অনুযায়ী, ১ হাজার ৬৭৩টি পরিবারের ৮ হাজার ৩২ জনের একটি তালিকা দিয়েছি। তারা আন্তরিকভাবে এই তালিকা নিয়েছে। সেটি যাচাই করে জানাবে, কবে থেকে নেওয়া শুরু করবে। এজন্য তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বাংলাদেশে আসা মিয়ানমারের নাগরিকরা যে এলাকায় থাকতেন সেটি একটি সম্ভাবনাময়ী এলাকা উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের নিবন্ধনে দেখা যাচ্ছে, ১০ লাখ ৬০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছে। এসব মানুষ কিভাবে ফেরত নেওয়া হবে, সেটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ব্যাপারে তারা খুবই আন্তরিক। প্রতিনিধিরা বলেছেন, ক্রমান্বয়ে সবাইকে নিয়ে যাবেন।
‘তারা পরিকল্পনা করেছেন রোহিঙ্গাদের রাখার জন্য আবাসন সুবিধা দিতে গ্রাম উন্নয়নের পাশাপাশি প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের শনাক্ত করে, মাধ্যমিক পর্যায়ে পুনর্বাসন করতে বাড়ি-ঘরের ব্যবস্থা করবেন। চূড়ান্ত পর্যায়ে তাদের স্থায়ী বসবাসের সুযোগ করে দেবেন। ভবিষ্যতে যেন আবার বাংলাদেশে আসতে না হয়। ’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রাখাইন সংকট নিরসনে জাতিসংঘের গঠিত কফি আনান কমিশন ও আমাদের ১০ পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করেই পুনর্বাসনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কারণ এসব মানুষ যাওয়ার পরে সেখানকার বর্তমান বাসিন্দারা থাকতে নাও দিতে পারে। তাই এসব কাজ করে পর্যায়ক্রমে তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা।
কামাল বলেন, এই মুহূর্তে দুই দেশের সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমারের ৬ হাজার নাগরিক অবস্থান করছে। আমরা বলেছি, এরা মিয়ানমারেই আছে। তারা বলেছে, এদের ফেরত নেওয়ার জন্য প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এজন্য ২০ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের একটি জেলায় বৈঠকে বসার অনুরোধ করেছেন দেশটির প্রতিনিধিরা। আমাদের একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্য প্রতিনিধিরা গিয়ে বৈঠক করবেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হবে কিভাবে তারা বাড়ি ফিরবে। এজন্য আমাদের সহযোগিতা চেয়েছে মিয়ানমার। আমরা রাজি হয়েছি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার মিয়ানমার সফরকালে ১০টি পয়েন্ট নিয়ে আলোচনার প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, গতবার যেসব বিষয়ে একমত হয়েছিলাম, সেগুলো বাস্তবায়ন ও অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে যে পাঁচটি পয়েন্ট উত্থাপন করেছিলেন এবং কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনে যেসব পয়েন্ট তুলে ধরা হয়েছে, তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে।
কামাল বলেন, মিয়ানমার সীমান্তে ইয়াবার ৪৯টি কারখানা শনাক্ত করে নাম দেওয়া হয়েছে। সেগুলো বন্ধ করার পাশাপাশি আমাদের দেশে ইয়াবার চালান বন্ধে মিয়ানমারের সহযোগিতা চেয়েছি। তারা এসব কারখানা বন্ধ করতে আশ্বস্ত করেছে। সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে বর্ডার পেট্রোলিং লাইন মেনে চলতে যে চুক্তি হয়েছে, তার বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
প্রত্যাবাসন এগিয়ে নিতে গঠিত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের মিটিং যেভাবে হচ্ছে সেভাবেই চলবে। সেটা যেন আরও ঘন ঘন হয় সে বিষয়ে কথা বলেছি। তারা একমত হয়েছেন, তাতে আমাদের আস্থা তৈরি হচ্ছে যে তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়ে যাবেন।
সীমান্তে লিঁয়াজো অফিস স্থাপনের আলোচনা হয়েছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বর্ডার লিঁয়াজো অফিস হবে। আমরা মনে করি, তারা যেভাবে আমাদের কাছে এসেছে, খুব শিগগির রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলে ছিলেন জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দীন, সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব ফরিদ উদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও সংশ্লিষ্ট দফতরের ১৮ প্রতিনিধি।
আর মিয়ানমার প্রতিনিধি দলে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লেফটেন্যান্ট জেনারেল কিয়াও সোয়ে’র নেতৃত্বে ছিলেন ১৫ প্রতিনিধি।
গত আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন শুরু হলে দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় লাখো রোহিঙ্গা, যা এখন পর্যন্ত ৭ লাখের বেশি। বিভিন্ন সংস্থার হিসাব মতে, সবমিলিয়ে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি।
প্রথম দিকে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ এই রোহিঙ্গাদের ‘অনুপ্রবেশকারী বাঙালি’ বলে আখ্যা দিলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের মুখে গত বছরের শেষ দিকে বাংলাদেশ থেকে জনগোষ্ঠীটির লোকদের ফিরিয়ে নিতে সমঝোতায় পৌঁছায়। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ঢাকার অভিযোগ, রাখাইনে প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরি না হওয়ায় এ প্রক্রিয়া এখনই শুরু হচ্ছে না। এ নিয়ে আলোচনা চলতে থাকার মধ্যেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে অংশ নিতে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলটি ঢাকায় এলো।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৮
ইএস/এইচএ
** চলছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক