ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বয়ে চলেছে সেই বোমার খোলস

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৮
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বয়ে চলেছে সেই বোমার খোলস পাকশীতে রেলের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক কার্যালয়ের সামনে সংরক্ষিত বোমার খোলস। ছবি: বাংলানিউজ

ঈশ্বরদী (পাবনা): ব্রিটিশ স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন ঈশ্বরদীর পাকশীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৪ ডিসেম্বর যুদ্ধবিমান থেকে বোমা ফেলে ব্রিজের একটি স্প্যান ভেঙে ফেলা হয়েছিল। সেই বোমার একটি অংশ এখনো বহন করে চলেছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। 

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) কার্যালয়ের সামনে বোমার খোলসটি সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বহু দর্শনার্থী ব্রিজ ভাঙার বোমার খোলসটি একনজর দেখতে আসেন।

স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ের এই স্মৃতি তরুণ প্রজন্মের কাছে শুধুই স্মৃতি।

বৃহস্পতিবার (১৩ ডিসেম্বর) সকালে পাকশী রেলওয়ে ডিআরএম চত্বরে গিয়ে দেখা যায়, নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতরে বোমার খোলসটি রাখা আছে। লোহার তৈরি খোলসটির ওজন প্রায় দুই মনের বেশি। বোমার খোলসটি লাল-সাদা রং দিয়ে সিমেন্টের বেদির ওপর সযত্নে গাঁথা রয়েছে।

সেদিনের স্মৃতিচারণ করে প্রভাষক আতাউল হক নান্নু বাংলানিউজকে বলেন, ‘সেদিন আমরা পরিবারসহ কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা বাহাদুরপুর থেকে ঈশ্বরদীর সিবিলহাট নানির বাড়ি যাওয়ার জন্য নৌকায় করে মোল্লার চরে এসে পৌঁছলাম। বেলা আনুমানিক ১১টার দিকে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর তিনটি বোমারু বিমান মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে বোমাবর্ষণ করতে থাকলো ব্রিজের ওপর। কিন্তু সেইগুলো লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছিল, মনে হলো তৃতীয়বারের চেষ্টায় তাদের লক্ষ্য সফল হলো। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ অনেকখানি ছিটকে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে পানিতে পড়ে গেলো। পুরো ঘটনাটি মুহূর্তের জন্য পরিবারের সকলে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করি। ’

‘তবে অনেকেই বলে, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী উড়িয়ে দিয়েছিল। আমি তাদের সঙ্গে একমত নই। সেদিন দুপুরে আকাশবাণীয় নীলিমা সান্যাল কিংবা ইভানাথ বলেছিলেন যে, পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটার সময় হার্ডিঞ্জ ব্রিজটি ধ্বংস করে দেয়। এভাবে খবর পরিবেশন হয়তো তাদের একটি কৌশল ছিল। তবে সেদিন হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ভাঙার পর হানাদার সেনাদের মনোবল ভেঙে গিয়েছিল’— যোগ করেন আতাউল হক নান্নু।

ব্রিটিশ স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন ঈশ্বরদীর পাকশীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ।  ছবি: বাংলানিউজসেদিন হার্ডিঞ্জ ব্রিজে বোমা হামলার বর্ণনা করে মুক্তিযুদ্ধকালীন কোম্পানি কমান্ডার অ্যাডভোকেট সদরুল হক সুধা বাংলানিউজকে বলেন, ‘যশোর-কুষ্টিয়া শত্রু মুক্ত হওয়ার পর হানাদাররা রেললাইনের ওপর দিয়ে ট্যাংক, গোলা-বারুদ নিয়ে ঈশ্বরদীর দিকে আসতে শুরু করে। খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের মোকাবিলা করার জন্য চরসাহাপুর প্রকৌশলী আব্দুল গফুরের বাড়ির সামনে অবস্থান নেন। যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে দলে দলে পাকিস্তানি হানাদাররা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পার হচ্ছিল। ব্রিজের ওপর তারা ডিনামাইট (চার্জ) লাগিয়ে বিদ্যুৎ সংযোজন করে রেখেছিল। অবস্থা বেগতিক দেখে ব্রিজটি উড়িয়ে দেওয়া হবে। এসময় তারা বেশ ক্ষুধার্ত ছিল। ’

তিনি বলেন, ‘পাকশী রেল টানেল ও বাঘইল রেল টানেলের মাঝখানে ৩০ জন পাকিস্তানি সেনা কাঁচা বেগুন খাচ্ছিলো। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা ঈশ্বরদী-কুষ্টিয়া সড়ক দিয়ে অবস্থান নিয়ে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালে পাকিস্তানি সেনারা কর্ণপাত না করে গুলি চালাতে থাকে।  

এসময় তারা পার্শ্ববর্তী পরিত্যক্ত ইট ভাটার গর্তে জীবন বাঁচানোর জন্য শুয়ে শুয়ে জয় বাংলা ধ্বনি দিতে থাকে। পরে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ঘেরাও করে ১৭টি রাইফেলসহ ঠাকুরের পুকুরপাড়ে নিয়ে যায়। এদিকে পাকিস্তানি সেনারা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তারা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপর দিয়ে ট্যাংক, কামান, ও জিপ নিয়ে পার হতে থাকে।  

এসময় মুক্তিযোদ্ধারা মিত্র বাহিনীর স্থানীয় কমান্ডারের কাছে ওয়্যারলেসের সাহায্যে বিমানবাহিনীর সহযোগিতা চায়। বেলা ১২টার দিকে পাকশীর আকাশজুড়ে ভারতীয় পাঁচটি যুদ্ধবিমান হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপর দিয়ে চক্কর দিতে থাকে। চার পাঁচটি বোমা ব্রিজে নিক্ষেপ করে।  

বোমার আঘাতে ব্রিজের ১২ নম্বর স্প্যানটি একদিকের অংশ ভেঙে পদ্মায় পড়ে যায়। আরেকটি স্প্যানের মারাত্মক ক্ষতি হয়। হঠাৎ বোমার আওয়াজে চমকে ওঠে মুক্তিযোদ্ধারা। এসময় দলবদ্ধভাবে অ্যাম্বুশ ভেঙে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায়। ’

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও গবেষক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা তখন বাঘইল গ্রামের পাকশী পেপার মিল ব্যাগাজ ইয়ার্ডের কাছে। দুপুর ১২টার দিকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী আকাশে মহড়া দিচ্ছিল। প্রথমে পর পর তিনটি এবং কিছুক্ষণ পর আরেকটি বিমান থেকে বোমা বিস্ফোরণের পর চরের ভেতর প্রচণ্ড ধোয়া এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। পরে আমরা গিয়ে দেখি ব্রিজের ১২ নম্বর স্প্যানের পশ্চিমভাগের অংশ পানির নিচে পড়ে আছে।  

সেদিন আরেকটি বোমা ফেলা হয়েছিল পাকশী রেলওয়ে স্টেশন প্লাটফর্ম থেকে ৫০ গজ দূরে ব্রিজের বালুচরের মধ্যে। আরেকটি বোমা পড়েছিলো রেললাইনের ওপর। বিমান থেকে ফেলা একটি বোমা বালুর ওপর পড়ায় বিস্ফোরিত হয়নি।  পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বালুর ভেতর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সেই বোমার খোলসটি আজও পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপকের কার্যালয়ের সামনে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। ’ 

পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল ইসলাম হবিবুল বাংলানিউজকে বলেন, ‘১৬ ডিসেম্বর ঈশ্বরদী শত্রুমুক্ত হলেও ১৯ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে পাক সেনারা আত্মসমর্পণ করে। বিজয় ঘোষণা হওয়ার পর হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে গিয়ে দেখা যায়, ১২ নম্বর স্প্যানটি একদিকে কাত হয়ে পানিতে পড়ে আছে।  

ব্রিজের ওপড় দিয়ে বিদ্যুতের তারের সঙ্গে খাকি পোশাকের পাক সেনারা বাদুরের মতে লটকে আছে। পাকিস্তানি একটি ট্যাংক সেসময় ব্রিজের ওপর পড়ে ছিল। ব্রিজ ভেঙে যাওয়ার কারণে ট্যাংকটি পাক সেনারা পার করতে পারেনি। ’

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) নাজমুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘ব্রিটিশ স্থাপত্য অনন্য নিদর্শন হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। আর মহান স্বাধীনতার যুদ্ধে যুদ্ধ বিমানে বিধ্বস্ত  ১২ নম্বর স্প্যানটি বোমার আঘাতে ভেঙে পড়ার পর স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রকৌশলীদের ইচ্ছা অনুযায়ী অনুরূপ একটি গার্ডার প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত সরকার তৈরি করে দেয়। ১৯৭৫ সালের ৫ আগস্ট আবার এই ব্রিজের ওপর দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের সঙ্গে উত্তর জনপদের পুনরায় রেল যোগাযোগ সচল হয়। ’

স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেরিয়ে গেছে। আজও বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ অন্যতম। দেশের দূর-দূরান্ত থেকে তরুণ প্রজন্ম থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষের মাঝে এ নিদর্শন দেখার কৌতূহল যেন কাটেই না। তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পাকশী রেলওয়ে বিভাগীয় প্রকৌশলীদের সহযোগিতায় মহান মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের এ স্মৃতি চিহ্নটি যত্নে সংরক্ষণ করে রেখেছে।  

বাংলাদেশ সময়: ০৪৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৮
জিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।