ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

‘আড়াইশ টাকা বেতনে সংসার চলে না’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৯
‘আড়াইশ টাকা বেতনে সংসার চলে না’ শুঁটকি মহালে কাজ করছেন নারী শ্রমিকরা, ছবি: বাংলানিউজ

কক্সবাজার: কক্সবাজারের নাজিরারটেক শুঁটকি মহালে কাজ করছে অন্তত ৪০ হাজার শ্রমিক। এদের অধিকাংশই নারী।

নারী শ্রমিকদের অভিযোগ, পেটের দায়ে, সংসার চালাতে তারা পুরুষের সমান কাজ করলেও ন্যায্য মজুরি তারা পাচ্ছেন না।

সমিতিপাড়ার নুর বানুর (৫১) দুই মেয়ে-এক ছেলে আর স্বামীসহ পাঁচজনের সংসার।

ছেলেটি প্রতিবন্ধী। সংসারের টানাপড়নের কারণে নাজিরারটেক শুঁটকি মহালে কাজ করেন তিনি।

নুর বানু বাংলানিউজকে বলেন, চার বছর আগে এখানে কাজ শুরু করি। তখন বেতন পেতাম ১৫০ টাকা।   এখন আড়াইশ টাকা পাচ্ছি। কোনো রকমে অনেক কষ্টে সংসার চালাই। শুটকি মহালে কাজ করছেন নারী শ্রমিকরা, ছবি: বাংলানিউজপাশের কুতুবদিয়াপাড়ার বাসিন্দা আরেফা বেগমেরও ঠিকানাও এখন নাজিরারটেক শুঁটকি মহাল। আরেফার পাঁচ সন্তান। আরেফা বললেন, সারাদিন কাজ করে আড়াইশ টাকা বেতন পাই। তা দিয়ে সংসার চলে না। তাই মাঝেমধ্যে ছেলেকে কাজ করার জন্য নিয়ে আসি।

আরেফা আক্ষেপ করে বাংলানিউজকে বলেন, পুরুষেরাও সারাদিন কাজ করে, আমরাও সারাদিন কাজ করি। সমান কাজ করলেও মজুরি পাই তাদের থেকে অর্ধেক।

কক্সবাজার শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে সাগরপাড়ে প্রায় ৫শ’ একর জমির উপর অবস্থিত  নাজিরারটেক শুঁটকি মহাল। এ মহালে কাজ করেন আরেফাদের মতো অন্তত ৪০ হাজার শ্রমিক। এর অধিকাংশ নারী। যারা এখন শুঁটকি উৎপাদন নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু নাজিরারটেক নয়, শীত মৌসুমের শুরুতে গত ভাদ্র মাস থেকে এখানে শুঁটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে। বিশেষ উপায়ে তৈরি বাঁশের মাচার উপর পাতলা করে বিছিয়ে সূর্যের তাপে কাঁচা মাছ শুকিয়ে শুঁটকিতে পরিণত করা হয় এখানে। বঙ্গোপসাগর থেকে সংগ্রহ করা ছোট-বড় প্রায় ৪০ প্রজাতির মাছ এখানে সূর্যের তাপে শুকানো হয়।

কথা বলারও ফুসরত নেই রশিদার। সেখানেই একটি আড়তে শুঁটকি উৎপাদনের কাজ করছিলেন রশিদা বেগম (৩০)।

রশিদা বাংলানিউজকে জানান, সেই ভোর থেকে কর্মব্যস্ততা শুরু। সূর্য ডোবা পর্যন্ত এ ব্যস্ততা চলবে।

পাশের আড়তের সুফিয়া বেগম জানালেন, সারাদিন কাজ শেষে মজুরি পাবো ২৫০ টাকা। তা দিয়েই চলে সংসার।

নাজিরারটেক শুঁটকি ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. আতিক উল্লাহ বাংলানিউজকে জানান, প্রতি মৌসুমে শুধুমাত্র নাজিরারটেক শুঁটকি মহালেই উৎপাদন হয় মাছের গুড়িসহ প্রায় ২০ হাজার টন শুঁটকি। এর বাজার মূল্য দুইশ’ কোটি টাকারও বেশি। উৎপাদিত এসব শুঁটকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতনি করা বিদেশেও। শুটকি মহালে কাজ করছে শ্রমিকরা, ছবি: বাংলানিউজতিনি বলেন, প্রায় পাঁচশ’ একর এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা এ শুটকি মহালে রয়েছে ছোট-বড় অন্তত এক হাজার আড়ত। দেশের সবচেয়ে বড় শুঁটকি মহাল এটি। ব্যবসায়ীও আছেন প্রায় দু’হাজার।

নাজিরারটেক শুঁটকি মহালের ব্যবসায়ী মো. শহিদুল্লাহ বাংলানিউজকে জানান, শীত মৌসুম শুরুর আগে থেকে নাজিরারটেক শুঁটকি মহালেও শুটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে। এবারও রূপচাঁদা, ছুরি, কোরাল, সুরমা, লইট্যা পোপা, কচাদা, হাঙ্গর, ফাইস্যা, নাইল্যামাছসহ ২০-৩০ প্রজাতির শুঁটকি এ মহালে উৎপাদন করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, বর্ষাকাল ছাড়া বছরের নয়মাস এখানে শুঁটকি উৎপাদন চলে।

তবে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, দেশের বৃহত্তম এ শুটকি মহাল থেকে সরকারকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব দেওয়া হলেও এখনো নাজিরারটেকে আসার পরিকল্পিত, চলাচলের উপযোগী কোনো রাস্তা নেই। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহন এখানে আসে হয় অতিরিক্ত ভাড়ায়। ফলে একদিকে শুঁটকির উৎপাদন খরচ যেমন বাড়ছে অন্যদিকে শুঁটকি উৎপাদনেও ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বিদ্যুতের অভাবে কোনো হিমাগার গড়ে না ওঠায় ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।

নাজিরারটেক শুঁটকি ব্যবসায়ী বহুমুখী সমিতির নেতা মো. হাশেম ও শ্রমিক নেতা মো. কায়সার বলেন, শুধু ককসবাজারের নয়, এখানকার উপযুক্ত (লবণাক্ত) আবহাওয়ার কারণে প্রতিবছর চট্টগ্রাম থেকে বিপুল পরিমাণ কাঁচামাছ শুকানোর জন্য এই মহালে আনা হয়, এবারও আনা হচ্ছে। উৎপাদনও খুব ভাল হচ্ছে।

তারা আক্ষেপ করে বললেন, এটি দেশের সবচেয়ে বড় শুঁটকি মহাল হলেও, এ মহালের উন্নয়নে সরকারের দৃষ্টি নেই। এখানে বড় সমস্যা অনুন্নত রাস্তা-ঘাট আর বিদ্যুৎ। এ দুই সমস্যার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

জেলা মৎস্য কর্মকতা ড. আব্দুল আলীম বাংলানিউজকে বলেন, বঙ্গোপসাগর থেকে আহরণ করা বিশেষ করে ছোট আকৃতির মাছগুলো দিয়ে শুঁটকি উৎপাদন করা হয়। শুধু কক্সবাজারে নয়, এখানে উৎপাদিত শুঁটকি ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, নাটোরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মানুষের চাহিদা মেটানো হচ্ছে এবং দেশের মানুষের প্রেটিনের বড় একটি অংশ কক্সবাজারে উৎপাদিত শুঁটকি থেকে পূরণ হচ্ছে। এমনকি, শুঁটকির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। যেখান থেকে বছরে ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৯
এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।