শিগগির আনুষ্ঠানিকভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছেই চিহ্নিত মাদক কারবারীরা আত্মসমর্পণ করবেন বলে পুলিশসহ বিভিন্ন পক্ষের মাধ্যমে বিষয়টি জানা গেলেও এখনো দিনক্ষণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে আত্মসমর্পণে দেখা যেতে পারে শতাধিক মাদক কারবারী, এদের মধ্যে ‘চিহ্নিত গডফাদার’ও থাকতে পারে।
একটি দায়িত্বশীল সূত্রে জানা যায়, আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে চিহ্নিত মাদক কারবারীদের মধ্যে পঞ্চাশেরও বেশি জন এরইমধ্যে পুলিশের হেফাজতে চলে গেছেন। বর্তমানে তাদের কক্সবাজার পুলিশ লাইনে রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির ফুফাতো ভাই কামরুল হাসান রাসেল, মো. শফিক, ভাগিনা সাহেদুর রহমান নিপু ও তালতো ভাই সাহেদ কামাল, চাচাতো ভাই ও বোন জামাই মো. আলমও রয়েছেন।
এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) এবিএম মাসুদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, মাদক কারবারীদের আত্মসমর্পণের একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ে এ বিষয়ে কাজ চলছে। তবে এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়।
তিনি বলেন, এ ধরনের একটি উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে ঠিক, কিন্তু সরকারের উচ্চপর্যায়ে অনুমোদন, কৌশল নির্ধারণসহ নানা বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্বান্তের ব্যাপার আছে। সবকিছু ঠিক হলেই আত্মসমর্পণের আয়োজন হবে। এখন পর্যন্ত দিনক্ষণের ব্যাপারে কিছু বলা যাচ্ছে না।
অর্ধশতাধিক ইয়াবা কারবারীকে পুলিশি হেফাজতে নিয়ে আসার বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন বলে জানান এসপি মাসুদ হোসেন।
বিজিবি, পুলিশ, কোস্ট গার্ড, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও গোয়েন্দা সংস্থার তালিকা অনুযায়ী, সারাদেশে ৩ হাজারেরও বেশি চিহ্নিত মাদক কারবারী রয়েছে। এদের মধ্যে মিয়ানমারের সীমান্তঘেঁষা কক্সবাজার জেলায়ই আছে ১ হাজার ১৫১ জন। তাদের মধ্যে আবার বেশিরভাগই টেকনাফের।
এসব চিহ্নিত কারবারীকে ধরতে গত ৪ মে থেকে সারাদেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযান জোরদার করা হয়। এ অভিযানে কেবল কক্সবাজারেই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৩৭ জন মাদক কারবারী নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩৪ জনই টেকনাফের। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতেও টেকনাফে সর্বনাশা মাদক ইয়াবার কারবার বন্ধ হয়নি। গত দেড়মাসে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্ট গার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হাতে ধরা পড়ে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ পিস ইয়াবা।
এদিকে পর্যটন শহর কক্সবাজারকে মাদকমুক্ত করতে এবং দুর্নাম ঘোচাতে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেটি যেন ফলপ্রসূ হয় এবং কোটি কোটি কালো টাকার মালিক হয়ে যাওয়া চিহ্নিত ইয়াবা গডফাদাররা যেন আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ায় জবাবদিহি ছাড়া পার পেয়ে না যায়, সে বিষয়ে বিষয়ে কৌশল নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছে সচেতন মহল।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সহ-সভাপতি প্রকৌশলী কানন পাল বাংলানিউজকে বলেন, মাদক কারবারীদের আত্মসমর্পণের বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসার পর এখন সব মহলে বিষয়টি আলোচনার শীর্ষে। সরকারের এ উদ্যোগকে অবশ্যই স্বাগত জানাই। তবে আত্মসমর্পণের বিষয়টি নিয়ে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের অবশ্যই কৌশলী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ এ ‘আত্মসমর্পণ’ যেন ইয়াবার চিহ্নিত গডফাদারদের পার পাওয়ার কৌশলে পরিণত না হয়।
টেকনাফ সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গুরা মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, কিছুদিন আগে মহেশখালীতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে জলদস্যুরা অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, ইয়াবা ব্যবসায়ীরা এখন কি ইয়াবা জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করবে? যদি তা-ই হয়, তাহলে টেকনাফের বড় বড় ইয়াবা গডফাদার যারা আছে, যারা ইয়াবা ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা, গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েছে, তাদের সম্পদের কী হবে? আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ার আনুষ্ঠানিকতার আগে সরকারকে এসব কৌশলী বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে।
সাবেক সংসদ সদস্য মো. আলী বাংলানিউজকে বলেন, আমরা শুনেছি আব্দুর রহমান বদি এ উদ্যোগটি নিয়েছেন। এটি মাদক নির্মূলে তার সদিচ্ছার প্রকাশও হতে পারে। তবে তিনি কার সঙ্গে আলাপ করে এ উদ্যোগ নিয়েছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাকি প্রধানমন্ত্রী- এসব কিছুই জানি না।
মো. আলী আরও বলেন, কারবারীদের তালিকায় যারা আছে তাদের ডেকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন বদি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাদক কারবারীদের তালিকায় যারা আছে এরা বেশিরভাগই চিহ্নিত মাদকবিক্রেতা। কিছু নিরীহ মানুষও তালিকায় রয়েছে। আবার এমনও আছে, ইয়াবার বড় গডফাদার, ইয়াবা ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে, কিন্তু তালিকায় তার নাম নেই। তার বিরুদ্ধে মামলাও নেই। তাহলে এসব গডফাদারদের কী হবে। তাদের কোন প্রক্রিয়ায় বিচার করা হবে? সবকিছু মিলিয়ে আমরা এখনো বিষয়টি নিয়ে অন্ধকারে আছি। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই, এটি ফলপ্রসূ উদ্যোগ হোক।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০১৯
এসবি/এইচএ/