ভাষা আন্দোলনে রাজশাহীতে সক্রিয় থেকে নেতৃত্বে দিয়েছেন সাঈদ উদ্দিন আহমদ। ৮৪ বছর বয়সে ২০১৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে মারা যান তিনি।
পরের বছরের ১৯ জুলাই ৭৭ বছর বয়সে ভাষা সৈনিক আবদুর রাজ্জাকও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ভাষা আন্দোলনের সময় তাদের অন্যতম আরও একজন ভাষা সৈনিক আবুল হোসেন। এখন বয়সের ভারে তিনিও ন্যুব্জ ও অসুস্থ। থাকেন রাজশাহীর মহানগরের নিজ বাড়ি শিরোইলের শান্তিবাগে।
তার স্মৃতিতে এখনও সমুজ্জ্বল ৫২’র ভাষা আন্দোলনের সব স্মৃতি। প্রবীণ ভাষা সৈনিক আবুল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, সব আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল রাজশাহী কলেজ। ‘ভাষা আন্দোলনে রাজশাহীর সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা বরাবরই সক্রিয় ছিল। আমরা ভাষা আন্দোলনে ঢাকার ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে তাল রেখে রাজশাহীতে আন্দোলন-সংগ্রাম কর্মসূচি পালন করতাম। ওই সময় রাজশাহীও ছিল উত্তাল। এখানকার ছাত্র-জনতা ছিল ভাষা আন্দোলনে অগ্রগামী’।
তিনি বলেন, ‘১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় ভাষার দাবিতে ছাত্র-জনতার আন্দোলন তখন তুঙ্গে। আমরাও রাজশাহীতে ভাষার দাবিতে আন্দোলন করেছি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে আমরা দিনভর ঢাকার খবর জানার জন্য গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। কারণ, রাজশাহীর ছাত্রদের মনে গভীর আশঙ্কা ছিল ঢাকায় বড় কিছু ঘটতে পারে’।
অবশেষে সন্ধ্যার দিকে রাজশাহীতে খবর এলো- ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলি হয়েছে। অনেক ছাত্র আহত ও নিহত হয়েছেন। ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলি চালানোর খবর পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে রাজশাহী শহরে বিষাদের ছায়া নেমে এলো। বন্ধ হয়ে গেলো দোকানপাটগুলো। তখন রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ কিছুই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ছিল একটি মেডিকেল স্কুল।
ফলে যাদের ছেলে-মেয়েরা উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়তে গিয়েছিলেন, গুলির খবরে তাদের বাড়ির লোকজন কান্নায় ভেঙে পড়েন। সাধারণ মানুষের জটলা শুরু হলো এখানে-সেখানে, রাস্তার মোড়ে-মোড়ে। সবাই জানতে উৎসুক, কী ঘটেছে ঢাকায়’।
ভাষা সৈনিক আবুল হোসেন আরও বলেন, এক পর্যায়ে কয়েক শ’ ছাত্র জমায়েত হলো রাজশাহী কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে। সবার চোখে-মুখে গভীর উৎকন্ঠা, কিন্তু দৃঢ় প্রত্যয়ে সবার কন্ঠেই উচ্চারিত হচ্ছিলো ‘ছাত্র হত্যার বিচার চাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। ’ রাজশাহী মেডিকেল স্কুলের সিনিয়র ছাত্র এস এম গাফ্ফারের সভাপতিত্বে ছাত্রদের সভা হয়’।
সভায় রাজশাহীতে দুর্বার গতিতে ভাষা আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য গঠিত হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। শহীদ ছাত্রদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ওই সভাতেই। ইট ও কাদা-মাটি দিয়ে যেভাবেই হোক, রাতেই শহীদদের স্মরণে একটি শহীদ মিনার তৈরি করতে হবে বলে সবাই উদ্যোগ গ্রহণ করি’।
এদিকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি হলেন মেডিকেল স্কুলের ছাত্র এস এম গাফ্ফার এবং যুগ্ম আহ্বায়ক হলেন রাজশাহী কলেজের সিনিয়র ছাত্র চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোলাম আরিফ টিপু (বর্তমানে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর) ও নাটোরের হাবিবুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘শহীদ মিনার নির্মাণ বা তার অবয়ব সম্পর্কে তখন আমাদের কোনো ধারণা ছিল না। এই অবস্থায় সারারাত জেগে ইট ও কাদা-মাটি দিয়ে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করলাম আমরা। শহীদদের স্মরণে স্তম্ভের গায়ে আমি নিজেই লিখে দিলাম ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’। আরও লিখে দেওয়া হলো কবিগুরুর বিখ্যাত কবিতার একটি চরণ- ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই। নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও একটি পুরনো ভাঙাচোরা ক্যামেরা দিয়ে সেই শহীদ মিনারের ছবি তোলা হয়, যা আজও সংরক্ষণ করা আছে। এদিকে আমরা সারারাত জেগে শহীদ মিনারটি নির্মাণ করি। পরদিন সকালে হরতালের পিকেটিং করার জন্য আমরা সবাই হোস্টেল থেকে বেরিয়ে পড়ি। এ সময় পুলিশ এসে শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলে। আমরা খবর পেয়ে বিকেলে এসে দেখি, পুলিশ শহীদ মিনারটি ভেঙে দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। তাই দাবি করছি, রাজশাহীতে নির্মিত প্রথম ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ বা শহীদ মিনারের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হোক। এর আগে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি আবেদন করা হয়েছে। আশা করি, সরকার প্রধান ভাষা আন্দোলনের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা থেকেই রাজশাহীর ভাষা আন্দোলনের এ অবদানকে স্বীকৃতি দেবেন'।
এছাড়া প্রথম শহীদ মিনারের স্বীকৃতির দাবিতে রাজশাহীতে গত ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে অনলাইন ভোটিং কার্যক্রম। এখনও তা অব্যাহত আছে। তাদের দাবি ভাষার মাসেই স্বীকৃতি মিলুক দেশের এই প্রথম শহীদ মিনারের।
রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মুহা. হবিবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ভাষার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় নিহতের খবর শুনে সেদিন সন্ধ্যার পরে রাজশাহী কলেজের মুসলিম হোস্টেলের সামনে ‘এ’ ব্লকের পূর্বদিকে শহীদদের স্মরণে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ একটি শহীদ মিনার গড়ে তোলে। সেই সময় থেকেই দেশের প্রথম শহীদ মিনারের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য গুঞ্জন শুরু হয়। কিন্তু এখনও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। বর্তমানে স্বীকৃতির দাবিতে অনলাইনে ভোটিং কার্যক্রম চলছে। এ আবেদনের কপি প্রধানমন্ত্রীর দফতরে দেওয়া হবে। তার প্রত্যাশা এই উদ্যোগের মাধ্যমেই রাজশাহীবাসীর প্রাণের দাবি পূরণ হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৯
এসএস/আরআইএস/