ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

মেয়ে ক্যান্সারে, আর ছেলে গেলো আগুনে

প্রশান্ত মিত্র, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৯
মেয়ে ক্যান্সারে, আর ছেলে গেলো আগুনে বন্ধুদের সঙ্গে ওয়াসি উদ্দিন মাহিদ ও সন্তান হারানো নাসিরুদ্দিন, ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: মো. নাসিরুদ্দিন চকবাজারের একজন ব্যবসায়ী। তিন মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে তার সুখের সংসার। তবে তার সুখের সংসারে প্রথম কষ্ট নেমে আসে ২০১১ সালের ১৬ ডিসেম্বর।

এদিন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত বড় মেয়ে আজরীন (২২) পরিবারের সবাইকে ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। বড় মেয়েকে হারিয়ে দুই মেয়ে আনহা (২৬), সারজা (১৫) এবং ছেলে মাহিদকে (২১) নিয়ে কেটে যাচ্ছিল সন্তানহারা নাসিরুদ্দিনের দিন।

কিন্তু কে জানতো বছর কয়েক পরেই আবারও সন্তান হারানোর আর্তনাদে ছেয়ে যাবে নাসিরুদ্দিনের বুক? গত বুধবার (২০ ফেব্রুয়ারি) রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টার আগুনে একমাত্র ছেলে ওয়াসি উদ্দিন মাহিদ পুড়ে মারা যান। মেয়ের পর অগ্নিকাণ্ডে ছেলেকে হারিয়ে এখন পাগলপ্রায় এ ব্যবসায়ী।  

বাড়িজুড়ে চলছে শোকের মাতম। একমাত্র ছেলে আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার পর ক্ষণে ক্ষণে মুর্ছা যাচ্ছিলেন পরিবারের সদস্যরা।

ওয়াসি উদ্দিন মাহিদ নবকুমার ইনস্টিটিউটের এইচএসসিতে লেখাপড়া করতো। সম্প্রতি বাবার সঙ্গে ব্যবসায় মনোনিবেশ করেছিল মাহিদ। চকবাজারের চুড়িহাট্টা, উর্দু রোডসহ রহমতগঞ্জে সুপরিচিত ছিল মাহিদ। বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ আর উচ্ছ্বাসেই সারক্ষণ মেতে থাকতেন তিনি।

অশ্রুসজল চোখে মাহিদের সমবয়সী চাচাতো ভাই আলীম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, মাহিদ ছিল অত্যন্ত মিশুক ও প্রাণবন্ত। আমি নিজ হাতে আমার ভাইয়ের কবর দিয়েছি। আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না মাহিদ আর নেই।

তিনি বলেন, ও শুধু আমার ভাই-ই নয়, খুব ঘনিষ্ট বন্ধুও ছিল। গত দু’দিন ধরে আমাদের দেখা হয় না। আমাদের একসঙ্গে ইজতেমায় যাওয়ার কথা ছিল এবার।  

কিন্তু বাইক চালতে গিয়ে হাতে ব্যথা পাওয়ায় ইজতেমায় যেতে পারেনি সে। সে আমাকে বলেছিল ‘আমি যেতে পারছি না, আমার জন্য দোয়া করিস ভাই। ’

মাহিদের বাবা মো. নাসিরুদ্দিন বলেন, আমার ছেলে তার মায়ের জন্য মিনারেল ওয়াটার কিনতে বাসা থেকে বের হয়, বোধ হয় চুড়িহাট্টার মোড় পর্যন্তও আসতে পারেনি, গাড়ি বিস্ফোরণের সময়ই হয়তো ও মারা যায়, আমরা মাহিদের মরদেহ মোটামুটিভাবে ভাল পেয়েছি। এখন এটাই আমার সান্তনা।

নাসিরুদ্দিন বলেন, অগ্নিকাণ্ডের মিনিট পাঁচেক আগেও আমি চুড়িহাট্টার মোড়ে ছিলাম। আমি পাশের এলাকা রহমতগঞ্জে গেলাম আর বিস্ফোরণের শব্দ পেলাম। আমি বুড়া হয়ে গেছি। মারা গেলেও হইতো, কিন্তু আল্লাহ কেন আমার তরুণ ছেলেটাকে নিয়া গেলো? আমি আর কতো সহ্য করবো, ২০১১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ব্লাড ক্যান্সারে বড় মেয়েকে হারাই। আগুন কেন আমাকে নিয়ে গেল না' বলেই বার বার চোখ মুছছিলেন ষাটোর্ধ এ ব্যবসায়ী।

ছেলে মাহিদের সঙ্গে শেষ কি কথা হয়েছিল জানতে চাইলে নাসিরুদ্দিন বলেন, বাইক চালাতে গিয়ে সে ব্যথা পেয়েছিল। ওর মাকে আমি বলেছিলাম ওকে ভিটামিন ‘সি’ খাওয়াও। মাহিদ আমাকে বলেছিল মাকে বল দুটো মাল্টা কেটে দিতে।

কান্না লুকিয়ে নাসিরুদ্দিন বলেন, শুধু রাসায়নিক কারখানা নয়, জুতার সলিউশনসহ নানা দাহ্য পদার্থের কারখানা আবাসিক এলাকায় বন্ধ করতে হবে। আমার মতো কোনো বাবার বুক যেন আর খালি না হয়।

অগ্নিকাণ্ডস্থল চুড়িহাট্টা মোড়ে খানিক পর পর ছুটে আসছেন নাসিরুদ্দিনসহ স্বজন হারানো অনেকেই। তারা কাঁদছেন, স্থানীয়রা সান্তনা দিচ্ছেন। তাতে কি আর স্বজন হারানোর ব্যাথা কমে? আবার কাঁদেন নাসিরুদ্দিনরা, এ কান্নার শেষ কোথায়?

বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৯
পিএম/ওএইচ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।