ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

চরফ্যাশনে নিহত ১০ জেলে পরিবারে শোকের মাতম

ছোটন সাহা, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৪৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৯
চরফ্যাশনে নিহত ১০ জেলে পরিবারে শোকের মাতম স্বজনদের আহাজারি। ছবি: বাংলানিউজ

ভোলা: ভোলার মেঘনায় ট্রলার ডুবিতে নিহত ১০ জেলে পরিবারে চলছে শোকের মাতম। স্বজনদের কান্না-আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে চরফ্যাশন আব্দুল্লাপুর, নুরাবাদ, নীলকমল ও ফরিদাবাদ গ্রাম। ঝড়ে কেউ হারিয়েছেন বাবা-ভাই সন্তান ও স্বামীকে।

পরিবারের একমাত্র উপার্জমক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে পরিবারগুলো। যে সাগরে মাছ শিকার করে তাদের জীবিকা নির্বাহ হতো সেই সাগরের মাছ শিকারে গিয়ে ফিরতে হয়েছে মরদেহ হয়ে।

ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’র কবলে পড়ে দুর্ঘটনায় মারা যায় ১০ জেলে।

নিহত জেলে হাসানের স্ত্রী কল্পনা কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, ফোনে বলেছিল কালকেই ফিরে আসবো’ কিন্তু সে ফিরে এলো না, ফিরলো তার মরদেহ। এখন তার ছেলে সন্তানকে কে দেখবে। তিনি ঘরের একমাত্র উপার্জন করার ব্যক্তি ছিলেন।

তিনি বলেন, ঝড়ের খবর পেয়ে তার (স্বামীর) খোঁজ নিতে যতবার ফোন দিয়েছি ততবার বন্ধ পেয়েছি, অনেকে জীবিত ফিরে এলো কিন্তু আমার স্বামী এলো না।

হাসানের বাবা আব্দুল কাদের বলেন, ঝড়ের আগে রাতে ফোন করেছিল হাসান। বলেছিল কালই বাড়িতে ফিরবো। ছেলেটাকে দেখে রেখো।   ছেলে আমার ফিরে এলো না, এখন তার স্ত্রী ও ৩ ছেলেকে কে দেখবে।

নিহত জেলে আব্বাসের স্ত্রী জরিনা বেগম স্বামীকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ। কান্না করে বার বার সজ্ঞাহীন হয়ে পড়ছেন।

আব্বাসের ২ ছেলে ৯ বছরের একটি ছেলে মেয়ে হাবিবা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। বাবাকে হারিয়ে তারাও কান্নায় ভেঙে পড়ছে।

নিহতের মেয়ে মোকাইরিমা বলেন, আমরা এতিম হয়ে পড়েছি, আমাদের দেখার কেউ রইলো না।

নিহতের শাশুড়ি আসমা বেগম জানান, মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার একদিন পর মাছ শিকারে গিয়েছিল আব্বাস। মাছ শিকার শেষে ফিরে আসার কথা থাকলেও আর ফিরে আসেনি। তার পরিবারের সদস্যরা এতিম হয়ে গেছে।

শুধু আব্বাস ও হাস নয়, তার মত ট্রলার ডুবিতে নিহত কামাল, মফিজ, বিল্লাল, নুরুন্নবী, রফিক, নজরুল, কবির ও খোরশেদের পরিবারেও একই অবস্থা।      

তদন্ত কমিটি গঠন: ট্রলার ডুবির ঘটনায় দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মৃধা মো. মোজাহিদুল ইসলামকে প্রধান করে এ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্য হলেন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ম্যাজিস্ট্রেট জাহিদুর ইসলাম। এ তদন্ত কমিটিকে আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

নিহত পরিবারকে আর্থিক সহায়তা: ঝড়ে নিহত ১০ জেলে পরিবারকে নগত ২৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা করেছে জেলা প্রশাসন। এছাড়াও পরবর্তিতে তাদের মৎস্য মন্ত্রণালয় থেকে নগদ এক লাখ টাকা করে দেওয়া হবে।

ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা: ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’র প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত লালমোহন ও চরফ্যাশন উপজেলার ১৬০টি পরিবারকে ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হয়েছে। প্রতি পরিবারকে নগদ ছয় হাজার টাকা, দুই বান্ডিল টিন ও শুকনো খাবার বিতরণ করেন জেলা প্রশাসক মাসুদ আলম ছিদ্দিক।

নিহতের ঘটনায় মামলা: ঝড়ের জেল নিহতের ঘটনায় বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ থানায় দু’টি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়েছে। একটি প্রশাসন ও অপর একটি নিহতের পরিবার এ মামলা দায়ের করেন।  

এদিকে ট্রলার ডুবিতে নিখোঁজদের উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে কোস্টগার্ডের পৃথক ৪টি টিম। ভোলা, উলানিয়া, বরিশাল ও মেহেন্দিগঞ্জ এ চার পয়েন্ট থেকে কোস্টগার্ড তাদের উদ্ধার কাজ করছে বলে নিশ্চিত করেছেন কোস্টগার্ড দক্ষিণ জোনের জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন মঈউদ্দিন।  

ভোলার জেলা প্রশাসক মাসুদ আলম ছিদ্দিক বলেন, ঝড়ে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এখনো ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি হচ্ছে, আমরা প্রাথমিকভাবে ১৬০টি পরিবারকে নগদ টাকা ও ত্রাণ দিয়েছি। এছাড়াও নিহতদের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। ট্রলার ডুবিতে নিহত পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, ট্রলার ডুবির ঘটনায় গঠিত টিম তদন্ত কাজ শুরু করছে, যারা দোষী তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

উদ্ধার হওয়া জেলের বক্তব্য: সেদিন দুর্ঘটনাকবলিত ট্রলারে ছিলেন চরফ্যাশনের শিবা গ্রামের বাসিন্দা জেলে আমজাদ হোসেন।

তিনি বলেন, ইলিশ নিষেধাজ্ঞার পরের দিন ২১ জেলে সাগরে মাছ শিকারে গিয়েছিলেন। চাঁদপুরে মাছ বিক্রি শেষে ফিরছিলেন ভোলায়। চাঁদপুর থেকেই আরও তিনজন মেহমান উঠে ট্রলারে। যারা ফিরবেন চরফ্যাশনে। কিন্তু দুপুরে হঠাৎ করেই আবহাওয়া খারাপ হয়ে যায়। ঝড়ের কবলে পড়ে তাদের ট্রলারটি। একপর্যায়ে ট্রলারটি উল্টে যায়। কেবিনে থাকা ১৯ জনের মধ্যে ৮ জন উদ্ধার হলেও ১১ জন বের হতে পারেনি। তাদের সবাই আটকা পড়েছিল। তারা সবাই মারা গেছে।

রোববার (১০ নভেম্বর) দুপুরে ঝড়ের কবলে পড়ে ভোলার ইলিশার মেঘনায় ২৪ জেলে নিয়ে আম্মাজান-২ নামে একটি মাছ ধরার ট্রলার ডুবে যায়। এ ঘটনায় তাৎক্ষণিক ১০ জেলে জীবিত উদ্ধার হয়। রোববার একটি ও সোমবার (১১ নভেম্বর) আরও ৯টি, মোট ১০টি মরদেহ উদ্ধার করেন পুলিশ ও কোস্টগার্ডের সদস্যরা। এ ঘটনায় নিখোঁজ রয়েছেন চারজন।

বাংলাদেশ সময়: ২১৪২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১৯
এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।