ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সিদ্ধান্ত নিলাম যতক্ষণ বাঁচবো প্রতিরোধ গড়বো

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৯
সিদ্ধান্ত নিলাম যতক্ষণ বাঁচবো প্রতিরোধ গড়বো ১৯৭১ সালে সংঘটিত বৃহৎ গেরিলা মুক্তিযুদ্ধের সেই মাঠে দাঁড়িয়ে আফতাব আলী। ছবি: বাংলানিউজ

কুষ্টিয়া: হঠাৎ মধ্য রাতে পুরো গ্রামে আগুন। বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ চলছে। বেপরোয়াভাবে গুলি করতে করতে পাকিস্তানিরা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। প্রায় চারদিক থেকে পুরো গ্রামটা ঘিরে নিয়েছে। আমাদের পিছু হটার কোনো সুযোগ ছিল না। আমরা ছিলাম মাত্র ১০ জন। তাও গেরিলা। সম্মুখযুদ্ধে আমাদের প্রশিক্ষণ ছিল না। যুদ্ধক্ষেত্রে জীবনের মায়া করলে তো হবে না। সিদ্ধান্ত নিলাম যতক্ষণ বাঁচবো প্রতিরোধ গড়বো। 

কথাগুলো বলছিলেন ১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর কুষ্টিয়ার সবচেয়ে বড় গেরিলা মুক্তিযুদ্ধ শেরপুর যুদ্ধে অংশ নেওয়া জীবন বাজি রাখা মুক্তিযোদ্ধা আফতাব আলী।  

১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর আজকের এই দিনে কুষ্টিয়া জেলার মধ্যে সবচেয়ে বড় গেরিলা মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়।

এ যুদ্ধে প্রথমে ১০ জন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ১০০ পাকিস্তানি হানাদারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।  

উভয়পক্ষ মুখোমুখি হয়ে প্রায় ৬ ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধের পর ভোর ৫টার দিকে হানাদার বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। জয় লাভ করে বাংলার বীর সন্তানেরা। তবে সে যুদ্ধে শহীদ হন হাবিবুর রহমান।

বেঁচে যাওয়া আফতাব আলীকে সেদিনের সেই স্মৃতি আজো তাড়া করে বেড়ায়। শহীদ হওয়া প্রিয় বন্ধুর মুখটা সামনে ভেসে ওঠে, কানে বাজে শহীদ হাবিবুরের শেষ কথাগুলো।  আজো তিনি শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন শত্রুদের বোমার আঘাতের চিহ্ন।  

আফতাব আলী ভয়াবহ সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বাংলানিউজকে বলেন, সেদিন ছিল ১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর। আমরা ১০ জন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা এই শেরপুর গ্রামে রাতে আত্মগোপনে ছিলাম। ভেবেছিলাম ভোরে চলে যাবো এখান থেকে। এরই মধ্যে মাঝ রাতে আমাদের অবস্থানের খবর পায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। আমরা মাত্র ১০ জন। তাও ছিলাম গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। সম্মুখযুদ্ধ তো আমরা করতাম না। আমাদের মূল কাজ ছিল লুকিয়ে থেকে শত্রুদের মারা। লক্ষ ছিল হিট অ্যান্ড রান। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা আমাদের অবস্থান টের পেয়ে যায়। তারা এক পাশ থেকে আগুন দিতে দিতে আমাদের দিকে আসতে থাকে। গ্রামের এক পাশের শেরপুর মাঠে আমরা অবস্থান নেই। তখন আর আমাদের সামনে অগ্রসর হওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। মাত্র ১০ জন, ভাবছিলাম কি করবো। একটা মাত্র এলএলআর এবং কয়েকটা এসএমজি। এ নিয়ে বৃষ্টির মতো গুলির মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা। আমার হাতে একটা রাইফেল।

তিনি বলেন, আমরা ৩ জন করে তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে শত্রুদের আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি আর হাবিবুর একসঙ্গে ছিলাম। সামনে এলএমজি দিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি আসছে। তখন আমি উঁচু আইল দেখে সেখানে অবস্থান নিলাম। হাবিবুর তখন সেই আইল এর কাছে আসছিল। এরই মধ্যে হঠাৎ একটা বুলেট এসে মাথায় লাগে হাবিবুরের। হামাগুড়ি দিয়ে গেলাম ওর কাছে। বললো মরে গেলাম রে..। তখন কিছু করার ছিল না। হামাগুড়ি দিয়ে পিছু হেঁটে চলছিলাম। তখনই খবর পেয়ে কুষ্টিয়া ই-৯ এর গ্রুপ কমান্ডার আফতাব উদ্দিন খাঁন প্রায় ১শ’ জন সুসজ্জিত মুক্তিবাহিনীর একটি দল নিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হন। তারপরে সাহস আরও বেড়ে যায়। চারিদিক থেকে আমরাও গুলিবর্ষণ শুরু করি।  

পিঠে বোমার আঘাতের চিহ্ন দেখাচ্ছেন আফতাব আলী।  ছবি: বাংলানিউজএলাকাবাসীরাও জেগে ওঠে। তখন পাকিস্তানি বাহিনীরা সৈন্যরা কোণঠাসা হয়ে যায়। তারা বুঝতে পারে না মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কত। হাবিবুরের দেহটা সেখানে রেখেই রাইফেল দিয়ে পিটিয়ে, মাথা থেতলে মেরেছিলাম সেই সেনাকে। যে গুলি করেছিল হাবিবুরকে।  

তৎকালীন কুষ্টিয়া ই-৯ এর গ্রুপ কমান্ডার আফতাব উদ্দিন খাঁন বাংলানিউজকে জানান, ১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর এ যুদ্ধে হাবিবুর রহমান নামে একজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এবং পঁচা বিশ্বাসের ছেলে হিরা ও মৃত আবুল হোসেন বিশ্বাসের ছেলে আজিজুল নামে দুই মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর এবং মঈন উদ্দিন, আব্দুল জব্বার, আব্দুর রশিদ ও হায়দার আলীসহ ২০ জন আহত হন। আমাদের আক্রমণে ৬০ জনের মতো পাক সেনা মারা যায়। পরে সেখান থেকে আমরা ৪টি এলএমজিসহ ১০৫টি অস্ত্র উদ্ধার করি।  

তিনি আরও বলেন, কুষ্টিয়া জেলায় সংঘটিত সর্ববৃহৎ এ গেরিলা যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর পরাজয় এবং ক্ষয়-ক্ষতির কারণে দৌলতপুর ও মিরপুর থানার বিরাট এলাকায় মুক্তিবাহিনীর অবস্থান আরও সুদৃঢ় হয়।  

ফলে মুজিব বাহিনীর কমান্ডার নাজুমুল করিম সুফি, গ্রুপ কমান্ডার হাবিবুর রহমান ও ইদ্রিস আলীর সহযোগিতায় পাহাড়পুর পুরাতন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মুক্তিবাহিনীর একটি শক্তিশালী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হাবিবুর রহমানের সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরপ্রতিক উপাধিতে ভূষিত করেন। হাবিবুর রহমান ১৯৫৩ সালে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার পিয়ারপুর ইউনিয়নের শেরপুর গ্রামের মেহের আলী মণ্ডল ও রাহেলা বেগম দম্পতির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন।  

১৯৭১ সালে হাবিবুর রহমান উপজেলার বড়গাংদিয়া হাইস্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী থাকাকালীন ভারতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। তিনি সাহসিকতার সঙ্গে জেলার বিভিন্ন স্থানে গেরিলা যুদ্ধ করেন। ১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর দৌলতপুর উপজেলার তার নিজ এলাকায় সংঘটিত জেলার সবচেয়ে বড় গেরিলা যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন এই বীর সৈনিক।  

বাংলাদেশ সময়: ১৪০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৯
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।