ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ভিয়েতনাম ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন

শাওন সোলায়মান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১৯
ভিয়েতনাম ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন কথা বলছেন ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ। ছবি: বাংলানিউজ

হ্যানয়, ভিয়েতনাম থেকে: প্রথমে ফরাসিদের আগ্রাসন, তারপর নিজেরাই দুই ভাগে বিভক্ত। পরবর্তীকালে ১৯৭৬ সালে মার্কিনিদের নাকানি-চুবানি খাইয়ে উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম এক হয়ে গঠিত হয় স্বাধীন ভিয়েতনাম। তবে বহির্বিশ্বের কাছে দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হওয়ার অপবাদ বয়ে বেড়াতে হয়েছে তাদের। তবে এখন তারা জানান দিচ্ছে নিজেদের অর্থনৈতিক শক্তিমত্তার। তৈরি পোশাক খাতে বিশ্বে তৃতীয়, ধান উৎপাদনে প্রথম, কফি উৎপাদন ও রপ্তানিতে দ্বিতীয়, মৎস্য প্রাণী আহরণে তৃতীয় ভিয়েতনাম।

দেশটির সামগ্রিক অর্থনীতি বিষয়ে বাংলানিউজকে জানিয়েছেন ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলানিউজের প্রতিবেদক শাওন সোলায়মান।

বাংলানিউজ: ভিয়েতনামের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন? যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের তকমা তো আর দেওয়া যাবে না।

সামিনা নাজ: নাহ, ভিয়েতনাম আর সেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ নেই। বাইরে থেকে যেমনই মনে হোক, অন্তত এখানে আসলে বোঝা যাবে ভিয়েতনাম কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে। দেশটির মাথাপিছু আয় এখন প্রায় আড়াই হাজার মার্কিন ডলার। জিডিপি এবছর সাত ছাড়িয়ে যাবে বলে দাবি তাদের। গত বছর ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের যে সভা এখানে হয়েছে, সেখানে ভিয়েতনাম দেখিয়েছে তারা কোথায় পৌঁছেছে। বিশ্বমহলও তাদের অর্থনীতির যথেষ্ট স্বীকৃতি দিয়েছে। এই সভাটি ভিয়েতনামের জন্য একটা ‘টার্নিং পয়েন্ট’ ছিল বিশ্ববাসীর কাছে নিজেদে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দেখানোর।

বাংলানিউজ: দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাই।

সামিনা নাজ: দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই আমার মধ্যে তাগিদ ছিল ভিয়েতনামের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে হবে। কারণ বর্তমান সময় অর্থনৈতিক কূটনীতির। কীভাবে ভিয়েতনামের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য বাড়ানো যায় এবং ভিয়েতনাম থেকে বিনিয়োগ পাওয়া যায় সেজন্য কাজ শুরু করি। এজন্য বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেই। যেমন, ভিয়েতনাম চেম্বার অব কমার্সের যিনি প্রেসিডেন্ট তিনিসহ স্থানীয় পর্যায়ের ব্যবসায়িক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তাদের কাছে বাংলাদেশের সম্ভাবনার দিকগুলো তুলে ধরেছি।

তবুও দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে ভিয়েতনামে আমাদের রপ্তানির চেয়ে আমদানি অনেক বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের হিসাবমতে, ভিয়েতনামে আমাদের রপ্তানি ৫৩ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন ডলারের বিপরীতে আমদানি ছিল ৫৬৪ দশমিক ৬৯ মিলিয়ন ডলার। যদি আমদানি-রপ্তানির দিক বিবেচনা করা হয় তাহলে আমরা পিছিয়ে আছি, এটা সত্য। তবে দেখতে হবে যে, আমরা তাদের থেকে কাঁচামাল নিচ্ছি। যেমন সিমেন্টের ক্লিংকার ও কিছু কৃষিজাত পণ্য। আবার আমরা তৈরি পণ্য বিদেশে রপ্তানি করছি। এরপরেও দুই পক্ষের বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়টিতে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করছি। ভিয়েতনামে ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আমরা আরও বেশি এধরনের পণ্য দেশটিতে রপ্তানি করতে পারি। এছাড়া, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে ১০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বাংলাদেশে গড়ে তোলা হয়েছে সেগুলো সম্পর্কে তাদের জানাচ্ছি। একটা তথ্য দেই, ২০০২ সালে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ছিল মাত্র ১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমি যখন দায়িত্ব নেই, তখন ছিল সাতশ’ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের কিছু বেশি। আর সবশেষ গত অর্থবছরে এই অংক আরও বেড়ে হয়েছে ৮১৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। আমরা আশা করছি, দ্রুতই দুই পক্ষের মধ্যে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ বাণিজ্য হবে।   

বাংলানিউজ: ভিয়েতনামের অর্থনীতির একটি বড় খুঁটি তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাত। তারা কি আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ নয়?

সামিনা নাজ: বিষয়টি আসলেই খুব চ্যালেঞ্জিং। সোজা বাংলায় বললে, আমাদের ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে তারা। এমন অবস্থায় সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করেছে তারা। এর ফলে ইউরোপের বাজারে বিনাশুল্কে আরএমজি পণ্য রপ্তানি করতে পারবে ভিয়েতনাম। এসডিজি অর্জন করে ফেললে আমরা হয়তো সেই সুবিধাটি হারাবো। এসব বিষয় নিয়ে আমি দেশে প্রতি মুহূর্তে প্রতিবেদন পাঠাচ্ছি। আমাদের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগে এই বিষয়ে কাজ করা হচ্ছে। বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফোরামে এই বিষয়গুলো তুলে ধরছেন।

বাংলানিউজ: পর্যটন ও তথ্য প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতেও ভালো করছে তারা।

সামিনা নাজ: প্রথমত পর্যটন খাত নিয়ে বলি। ভিয়েতনামের ‘গড গিফটেড’ কিছু সম্পদ রয়েছে, যেমন হা লং বে। অষ্টম আশ্চর্যেও রয়েছে এটি। এর বাইরে বেশ কিছু স্থান রয়েছে যা ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হওয়ার খেতাব অর্জন করেছে। সবচেয়ে বড় কথা, তারা এগুলো খুব সুন্দরভাবে প্রমোট করতে পেরেছে। তাদের মধ্যে পেশাদারিত্ব রয়েছে, পরিশ্রম দেওয়ার মানসিকতা রয়েছে। তাদের ট্যুরিজম প্রমোটের একটা উদাহরণ দেখেন। গত এপেক শীর্ষ সম্মেলন তারা করেছে দানাংয়ে, তাদের একটি অন্যতম পর্যটন স্থান। এখানে সম্মেলন করার জন্য ২০১৪ সাল থেকেই ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন শুরু করে। আবার এবারের এপিকটা সম্মেলন হলো হা লংয়ে। রাজধানী হ্যানয়ে কিন্তু হয়নি। এভাবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইভেন্ট একেকবার একেক পর্যটন শহরে আয়োজন করে পর্যটকদের কাছে তুলে ধরে। আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরে। আমাদের দেশেও কক্সবাজারে আমরা এমন কিছু করেছি, তবে সেগুলো আরও বাড়াতে হবে। এর জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন করে এমন কিছু করতে হবে আমাদের।

এবার আসি আইসিটিতে। আইসিটিতে ওরা ভালো করছে, তবে আমরাও পিছিয়ে নেই। আমরাও বেশ সফলতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছি। আপনাকে দেখতে হবে, ভিয়েতনামের জন্য বিনিয়োগকারী কারা। ভিয়েতনামে আইসিটিসহ অন্য খাতেও বড় বিনিয়োগকারী দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান। এছাড়া চীন তো আছেই। এদের মধ্যকার এবং আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর একটি দর্শন রয়েছে। সেটি হচ্ছে, অপেক্ষাকৃত গরিব রাষ্ট্রকে সাহায্য করবে ধনী রাষ্ট্র। সেই জায়গা থেকে ভিয়েতনাম মোটা অংকের কিছু বিনিয়োগ পাচ্ছে।

বাংলানিউজ: শেষ প্রশ্ন, ‘ইজ অব ডুইং বিজনেস’ (সহজ ব্যবসা সূচক) র‌্যাংকিংয়ে এগিয়ে ভিয়েতনাম। এটাকে কীভাবে দেখছেন?

সামিনা নাজ: প্রতিটা দেশের নিজেদের কিছু নেতিবাচক দিক বা দুর্বলতা রয়েছে। তাই এভাবে তুলনা করে পুরো বিষয়টি হয়তো বোঝা যাবে না। বরং কার কী ইতিবাচক বা শক্তিশালী দিক আছে, সেটি দেখা দরকার। যেমন আমরা গণতান্ত্রিক দেশ আর ভিয়েতনাম সমাজতান্ত্রিক। এদিক থেকে আমাদের একটা ব্র্যান্ড ভ্যালু আছে। আমাদের দেশের মতো মানবাধিকার, সামাজিক মূল্যবোধ ভিয়েতনামে নেই। আমরা অল্প কিছু রাষ্ট্রের মধ্যে অন্যতম যারা মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জন করেছি, এখন এসডিজি অর্জনের পথে। বিভিন্ন বিষয়ে রাষ্ট্র হিসেবেও আবার আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন পদক অর্জন করেছেন। এগুলো কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে বহির্বিশ্বের কাছে আমাদের ব্র্যান্ডিং। তবে হ্যাঁ, আমাদের আরও উন্নতি করা দরকার এটি যেমন সত্য, তেমনি ভিয়েতনামেও যে সব কিছু খুব সহজ, তা কিন্তু না।

এখানে যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে একটা আমলাতান্ত্রিক চেইনে আগায় তারা। শুধু বাংলাদেশ না বিশ্বের অন্য কোনো দেশ থেকেও একটি প্রস্তাব পেলে সেটি আগে যাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ডেস্কে। যেমন বাংলাদেশ দিয়ে বললে বাংলাদেশ ডেস্কের ডিজির কাছে আমাকে প্রথমে কিছু উত্থাপন করতে হয়। সেখান থেকে যাবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে। সেখান থেকে আবার আসবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। একই সঙ্গে পাবলিক সিকিউরিটি বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট অন্য মন্ত্রণালয় থেকে ভেটিং নেওয়া হয়। সেখান থেকে যায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। সেখান থেকে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে। তারপর যাবে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে। সেখান থেকে যাবে কেন্দ্রীয় কমিটির পলিট ব্যুরোর কাছে। সবশেষে উপদেষ্টা ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। বুঝতে হবে, শুধু বাংলাদেশ না, যেকোনো দেশের জন্যই ভিয়েতনামের সঙ্গে কাজ করতে হলে বেশ সময় ও ধৈর্য নিয়ে করতে হবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১০৪৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১৯
এসএইচএস/একে

আরও পড়ুন..

**রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভিয়েতনামকে পাশে পাওয়ার আশা বাংলাদেশের​

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।