ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বরিশাল-ঢাকা রুটে পানির নিচে নৌযান, বিপদের শঙ্কা

মুশফিক সৌরভ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৫৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০২০
বরিশাল-ঢাকা রুটে পানির নিচে নৌযান, বিপদের শঙ্কা বরিশাল-ঢাকা নৌ-রুট। ছবি: বাংলানিউজ

বরিশাল: বরিশাল-ঢাকা নৌ রুটে প্রায়ই ঘটছে নৌ-দুর্ঘটনা। তবে গত কয়েক বছরে এসব দুর্ঘটনায় নৌযান ডুবির মতো ঘটনা ঘটলেও হতাহতের সংখ্যা অনেকটাই কমে গেছে।

আর ডুবে যাওয়া নৌযান উদ্ধারে ধীরগতির কারণে নৌ-রুটে যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌ-রুট অনেকটাই বিপদজনক হয়ে উঠছে। চালকদের মতে, চ্যানেল বন্ধ হয়ে যাওয়া, সরু হয়ে যাওয়াসহ নানান সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাদের।

আর উদ্ধারে ধীরগতির কারণ হিসেবে বিআইডব্লিউটিএর যে ৪টি উদ্ধারকারী জাহাজ রয়েছে সেগুলোর ক্ষমতা যথেষ্ট নয় বলে তারা অভিযোগ করেছেন।

যাত্রীবাহী নৌ-রুটকে নিরাপদ করতে ডুবে থাকা নৌযানগুলো দ্রুত উদ্ধারের দাবি জানিয়েছেন যাত্রী ও চালকরা।

লঞ্চ চালকের দেয়া তথ্যানুযায়ী, বরিশাল-ঢাকা রুটে ৮-৯ টির মতো নৌযান ডুবে আছে, যেগুলো উদ্ধার করা হয়নি। এগুলেঅর সবই মালবাহী নৌযান (বাল্কহেড-কার্গো)। বরিশাল নদী বন্দর সংলগ্ন কীর্তনখোলা নদীতে-১টি, মেহেন্দিগঞ্জের উলানিয়া-কালিগঞ্জ সংলগ্ন নদী এলাকায় ৫টি, ষাটনল, আমিরাবাদ ও শেওড়াতে ১টি করে রয়েছে।

তবে বিআইডব্লিউটিএ সূত্র বলছে, আমিরাবাদ, শেওরাসহ মৌলুভীরহাটে ডুবে যাওয়া নৌযানগুলো এরইমধ্যে তুলে ফেলা হয়েছে। আর হিজলার মিয়ারচর এবং বামনিরচরে ডুবে থাকা তিনটি জাহাজ বেসরকারিভাবে উত্তোলনের কার্যক্রম চলছে।

এরমধ্যে গত বছর মিয়ারচরের মূল চ্যানেলে ডুবে যাওয়া ক্লিংকারবাহী বাল্কহেডটিও রয়েছে। তবে সেটির পলি পড়ে আটকে যাওয়া ও মাঝ বরাবর ভেঙে যাওয়ায় উত্তোলনে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

লঞ্চের মাষ্টাররা বলছেন, বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে চলাচলরত লঞ্চগুলো আগের চেয়ে আকারে অনেক বড়। তাই এগুলো চলতে বেশি জায়গা ও পানির প্রয়োজন হয়। নৌযান ডুবির পরে মিয়ারচর চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেলে বর্তমানে উলানিয়া কালিগঞ্জ হয়ে বরিশাল-ঢাকা রুটে নৌযান চলাচল করছে। অপরদিকে শীতের এ সময়টাতে নদীতে পানি এমনিতেই কম থাকে, আবার উলানিয়া-কালিগঞ্জসহ বরিশাল ঢাকা রুটে ডুবোচরেরও কোন অভাব নেই, তাই জোয়ার-ভাটাসহ অনেক হিসেবে নিকেশ কষে লঞ্চ চালাতে হয়।  

লঞ্চ চালকদের মতে, ডুবে যাওয়া নৌযানগুলোর কারণে চ্যানেলগুলো সরু হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি আশপাশে পলিও পড়ে যাচ্ছে। ফলে দ্রুত উত্তোলন না করা হলে ওইসকল জায়গায় নাব্যতা সংকট দেখা দিবে। আর শীত মৌসুমে কুয়াশায় ডুবে যাওয়া নৌযানের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধলে প্রাণহানির মতো দুর্ঘটনার শঙ্কার কথাও জানিয়েছেন তারা।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নৌ-দুর্ঘটনায় ডুবে যাওয়া নৌযান উদ্ধারে একটি নির্ধারিত পরিকল্পনায় কাজ করে বিআইডব্লিউটিএর উদ্ধারকারী দফতর। এক্ষেত্রে মালিক নিজে নৌযানটি উদ্ধার করতে চাইলে বেশকিছু দিনের সময় দেয়া হয়। এরপর উদ্ধারকাজ শুরু করলে অবস্থা বুঝে সময় বাড়িয়েও দেয়া হয়। তবে উদ্ধার কাজ মালিক না করলে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ নিলামের মাধ্যমে সেটিকে নদী থেকে অপসারণ করে। আর উভয় মাধ্যমেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সনাতন ও আধুনিক প্রযুক্তির মিশ্রন ঘটিয়ে নৌযান উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করে। এক্ষেত্রে সময়টা বিলম্বিত হতে থাকে।  

অপরদিকে বিআইডব্লিউটিএর উদ্ধারকারী জাহাজ আছে চারটি। যার মধ্যে ৬০ টন করে উত্তোলন ক্ষমতাসম্পন্ন হামজা কেনা হয় ১৯৬৪ সালে, আর রুস্তম কেনা হয় ১৯৮২ সালে। সবশেষ ২০১২ সালে কোরিয়া থেকে আনা উদ্ধাকারী জাহাজ ‘নির্ভিক’ ও ‘প্রত্যয়’ এর উত্তোলন ক্ষমতা ২৫০ টন করে। এগুলো একত্র করলে সর্বোচ্চ ৬২০ টন পর্যন্ত ডুবন্ত জাহাজ উত্তোলন করা সম্ভব। কিন্তু সম্প্রতি যে কয়টি মালবোঝাই নৌযান ডুবেছে তার প্রত্যেকটির ওজন ডুবে যাওয়ার পর হাজার টনের কাছে গিয়ে ঠেকেছে। ফলে এর একটিকেও উদ্ধারে কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি উদ্ধারকারী জাহাজ।

ঘটনাচক্রে গত ১৪ ডিসেম্বর কীর্তনখোলা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে ১২শ’ টন ক্লিংকারসহ এমভি হাজি মোহাম্মদ দুদু মিয়া-১ কার্গো ডুবে যায়। কার্গোটির ওজন ৬শ’ টন। ক্লিংকার ও পানির কারণে কার্গোটির ওজন আরও ২শ’ মেট্রিক টন বেড়েছে। এ অবস্থায় কার্গোটি উদ্ধারের সক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও উদ্ধারকারী জাহাজ ‘নির্ভিক’ ডুবে যাওয়া কার্গোর পাশে কয়েকদিন অবস্থানের পর নিজ ঘাটে আবার নোঙ্গর করতে বাধ্য হয়। এভাবে ওজনের কারণে গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে মিয়ারচরে ডুবে যাওয়া একটি মালবাহী বাল্কহেড এখনো উদ্ধার করা হয়নি। ফলে ওই চ্যানেলটিই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই চ্যানেলটি সচল রাখতে সরকারি উদ্যোগে প্রতিবছর বিপুল অর্থ ব্যয়ে ড্রেজিং করা হয়।

লঞ্চ মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর দেশে সর্বোচ্চ চার হাজার টন ওজনের জাহাজ নির্মাণের অনুমতি দিচ্ছে। যে ধরনের লঞ্চ বরিশাল-ঢাকা কিংবা বরিশাল-ভোলা রুটে রয়েছে। তাই যেকোনও ধরনের বিপদ মোকাবিলায় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন উদ্ধারকারী জাহাজ সংগ্রহের দাবি জানান তিনি।

সার্বিক বিষয়ে নৌ সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের যুগ্ম পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) রফিকুল ইসলাম বলেন, একটি নৌযান ডুবে যাওয়ার পর বেশি কিছু বিষয় নিয়ে কাজ করা হয়ে থাকে। যারমধ্যে চ্যানেলে নৌযান চলাচলের ব্যবস্থা সচল রাখা, সিগন্যাল বাতি ও বয়া বসানো, যেটি ডুবে যাওয়া জাহাজের অবস্থান নিশ্চিত করবে। বরিশাল-ঢাকা রুটে ডুবে যাওয়া নৌযানগুলোর ক্ষেত্রে এগুলো সবসময় শতভাগ নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। আর এখন যে নৌযানগুলো ডুবন্ত রয়েছে তার বেশিরভাগেরই উদ্ধারে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আর এ কাজ মালিকপক্ষ না করলে নির্ধারিত সময় শেষে আমরাই আমাদের নিয়মে এগুলো অপসারণের ব্যবস্থা করবো। আর উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন উদ্ধারকারী জাহাজ কেনার চিন্তাভাবনা কর্তৃপক্ষের রয়েছে। ’

বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর এম মাহবুব-উল ইসলাম বরিশালের কীর্তনখোলায় ডুবে যাওয়া এমভি হাজি মোহাম্মদ দুদু মিয়া-১ কার্গোটি অবস্থা পরিদর্শনে এসে উদ্ধারকারী জাহাজের উত্তোলন ক্ষমতার থেকে ডুবে যাওয়া নৌযানের ওজন বেশি হওয়ার বিষয়ে বলেন, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন উদ্ধারকারী জাহাজ সংযোজনের চিন্তাভাবনা সরকারের রয়েছে। সেইসাথে প্রযুক্তির ব্যবহারের বিষয়টি চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে নদী তীরে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা বিভিন্ন স্থাপনার কারণেও চ্যানেল সরু হয়ে যাচ্ছে বলে দাবি করেছেন মাস্টাররা। বরিশাল-ঢাকা রুটের এমভি মানামী লঞ্চের মাস্টার আসাদুজ্জামান জানান, শুধু মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকার সদরঘাট পর্যন্ত যেতে ১ দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। কিন্তু এই দেড় ঘণ্টার পথে চোখের পলক দেয়াটাও কঠিন। কারণ এটুকু নদীপথের দুই প্রান্তে থাকা শিপ-ডক ইয়ার্ড রয়েছে। ফেলে নৌ-পথ এতোটাই সরু হয়ে গেছে যে পাশাপাশি দুটি লঞ্চ চালানো যায় না। একটি চালনা করে নিতেও হিমশিম ক্ষেতে হয়।

বাংলাদেশ সময়: ০০৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০২০
এমএস/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।