এদিকে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে ১৪.৫ কিলোমিটার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এশিয়ান ড্রেজিং লিমিটেড নদী খননের কাজ পেলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজসে তারা সাব ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে অবাধে শতাধিক বাংলা ড্রেজার বসিয়ে বালু ও মাটি উত্তোলন করে বিক্রি করে চলেছে। এ কারণে স্থানীয়দের মধ্যে দেখা দিয়েছে ক্ষোভ।
টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, নদী খনন করে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে বুড়িগঙ্গাকে দূষণমূক্ত করা, বুড়িগঙ্গা-তুরাগ রুটে সারা বছর নৌ-চলাচলের উপযোগী করাসহ সেচ ও মৎস্য উন্নয়নের জন্য নেওয়া প্রকল্পটির মাত্র ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। ৯৪৪ কোটি ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১০ সালে প্রকল্পটি নেওয়ার পর তিন দফা মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২০ সাল পর্যন্ত করা হয়। শেষ পর্যন্ত ডিজাইন বদলাতে হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বৃদ্ধি করা হচ্ছে। তবে ৩ বছরের এই প্রকল্প বাস্তবায়নে লাগতে পারে ১১ বছর!
এছাড়া আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ সালের এপ্রিলে নেওয়া প্রকল্পটি ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু দুই দফায় ব্যয় না বাড়িয়ে মেয়াদ বাড়ানো হয়। এতেও কাজ না হওয়ায় সর্বশেষ উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধনের সময় ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ ঠিক করা হয়। এক্ষেত্রে মূল ডিপিপির তুলনায় ৬ বছর ৬ মাস বা ১৭৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ সময় বেশি লাগছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরাও ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর কথা বলছেন। নতুন করে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ১২৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।
সরেজমিন দেখা যায়, নদী খনন এলাকা কালিহাতী উপজেলার বেলুটিয়া গ্রামে নারায়ণগঞ্জ থেকে দুইটি ড্রেজিং মেশিন আনা হয়েছে খননের জন্য।
এসময় কথা হয় মো. আরিফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, দীর্ঘ আড়াই বছর ধরে তিনিসহ ড্রেজিং-এর কাজে নিয়োজিত ২০জন রয়েছেন এখানে। তারা স্থানীয়দের কারণে আড়াই বছরেও খনন কাজ শুরু করতে পারেননি। খনন করতে গেলেই স্থানীয়দের বাধার মুখে পড়তে হয়। তাই বাধ্য হয়েই তারা খনন কাজ বন্ধ রেখেছেন।
এসময় কথা হয় আব্দুস সাত্তার খান নামের অপর একজনের সঙ্গে। তিনি জানান, গত তিন বছর বেলুটিয়া এলাকায় পানি প্রবাহের মূল উৎসমুখ খনন করা হয়। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে ভরাট হয়ে তা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। এ কারণে এ কাজে নিয়োজিতরা আবার অন্য জায়গায় খনন করতে শুরু করে। এতে এলাকাবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে তা বন্ধ কের দেয়। তাদের দাবি জমি অধিগ্রহণের টাকা না পাওয়া পর্যন্ত এ এলাকায় নদী খনন করতে দেওয়া হবে না।
মোজাম মন্ডল নামের একজন স্থানীয় বাসিন্দা জানান, তার জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে ৫২ হাজার টাকা মূল্যে। তার ৬০ খতিয়ানের ২১৬ দাগের ও ২৭ দাগের ৮০ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনি কোনো জমির মূল্য পাননি। এ নিয়ে কয়েকবার কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে কোনো লাভ হয়নি।
একই অভিযোগ দেলোয়ার হোসেনের। তিনি জানান, তার ২২৩ খতিয়ানের ৬৭০ দাগের ১১৯ শতাংশ জমি ৮৫ হাজার টাকা মূল্যে অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তিনি শুনেছেন, তার অধিগ্রহণের টাকা সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে এসেছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারেন লাখে ১০ হাজার টাকা দিলে তাকে জমি অধিগ্রহণের চেক দেওয়া হবে। পরে তিনি চেক না নিয়ে ফিরে আসেন।
আ. আওয়াল প্রামাণিকেরও একই অভিযোগ। তিনি জানান, ৪২ খতিয়ানের ১০৮ শতাংশ জমি ৬০ হাজার টাকা দরে অধিগ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু তার কাছে লাখে সাত হাজার টাকা দাবি করেন সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা।
টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, নদী খননের কাজ টাঙ্গাইল অংশে দুইটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে। এর মধ্যে মির্জাপুর অংশে বংগজ ড্রেজিং লিমিটেড এবং কালিহাতী অংশে এশিয়ান ড্রেজিং লিমিটেড। তবে নীতিমালায় উল্লেখ আছে নদী খননের কাজে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিজেরাই নদী খনন করবেন এবং এতে কোনো প্রকার সাব ঠিকাদার বা নিষিদ্ধ বাংলা ড্রেজার ব্যবহার করা যাবে না। প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম ছিল ভূমি অধিগ্রহণ, গাইড বাঁধ নির্মাণ, কায়িক শ্রম ও ড্রেজারের মাধ্যমে নদী খনন, সেডিমেন্টবেসিন নির্মাণ ও সংরক্ষণ কাজ, ব্রিজের ফাউন্ডেশন ট্রিটমেন্ট এবং পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং করা।
এদিকে উপজেলার জোকারচর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এশিয়ান ড্রেজিং লিমিটেড একটি মাত্র ড্রেজার মেশিন দিয়ে নদী খননের কাজ করছে। এসময় ড্রেজিং-এর কাজে নিয়োজিত নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শ্রমিক বাংলানিউজকে জানান, টাঙ্গাইলের কালিহাতী অংশে নদী খননের কাজ পেয়েছে এশিয়ান ড্রেজিং লিমিটেড। কিন্তু তারা ‘মা’ এন্টারপ্রাইজকে নদী খননের জন্য সাব ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ দেয়। এতে সাব ঠিকাদাররা নদী খননের নামে শতাধিক বাংলা ড্রেজার বসিয়ে বালু ও মাটি উত্তোলন করে চলেছে। আর এসব বালু ও মাটি বিক্রি করছে তারা।
আবার ‘মা’ এন্টারপ্রাইজ ২৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে নদী খননের জন্য সাব কন্ট্রাক দিয়েছে এলাকার বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের। এর মধ্যে উপজেলার বল্লববাড়ির বাছেদ ২৫০ মিটার, সরাতৈল গ্রামের জহরুল ইসলাম ৫০০ মিটার, চানমিয়া ও গুলজার ২৫০ মিটার, কুষাবেনু গ্রামের রফিক খান ৫০০ মিটারে বাংলা ড্রেজার বসিয়ে নদী খনন করছেন। এরপর চার কিলোমিটার নদী খনন করছে মা এন্টারপ্রাইজ। আবার আনিস মিয়া ২০০ মিটার, নুরুল ইসলাম ৩০০ মিটার, পটল গ্রামের সোহেল মিয়া ৫০০ মিটার, এরপর ৫০০ মিটার মা এন্টারপ্রাইজ নদী খনন করছে। এরপর ইউপি সদস্য সুলতান ৫০০ মিটার নদী খনন করছে। পরের ৫০০ মিটার করছে মা এন্টারপ্রাইজ। এরপর থেকে মশিউর ৫০০ মিটার, ইউপি চেয়ারম্যান আলিম ৫০০ মিটার, ইউপি সদস্য সোনা মিয়া ২৫০ মিটার রাসেল ভূঁইয়া ৫০০ মিটার, এলেঙ্গা পৌর এলাকার লাভু মিয়া ৫০০ মিটার, বাশি গ্রামের জলিল মিয়া ৩০০ মিটার নদী খননের কাজ পেয়েছেন। নদী খননের কাজ পেয়েই তারা দীর্ঘদিন ধরে নদীতে নিষিদ্ধ বাংলা ড্রেজার বসিয়ে বালু ও মাটি উত্তোলন করে প্রতিদিন শতশত ট্রাক মাটি ও বালু বিক্রি করে চলেছেন।
এদিকে এভাবে নদী খননের নামে বাংলা ড্রেজার বসিয়ে বালু ও মাটি উত্তোলনের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে পুরো এলাকা। স্থানীয়দের অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব প্রকল্পটি (নিউ ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ-বুড়িগঙ্গা রিভার সিস্টেম) এভাবে নিয়মবহির্ভূতভাবে নদী খনন করলে নদীর পাড়ের মানুষ আরও হুমকির মুখে পড়বে। আর এ কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন যেখানে বালু দেখে সেখানেই নদী খনন শুরু করে।
জোকারচর গ্রামের শেখ মো. আবুল হাশেম বাংলানিউজকে বলেন, এখানে নদী খনন হচ্ছে নাতো। সরকারের কোটি কোটি টাকা অপচয় করছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। যেভাবে বাংলা ড্রেজার দিয়ে নদী খনন করা হচ্ছে এটা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সব জেনেও না জানার ভান করেন। আমরা কিছু বললেই স্থানীয় সরকার দলীয় ক্যাডার বাহিনী দিয়ে ভয় দেখায়। এ কারণে স্থানীয় লোকজন কিছু বলতে সাহস পায় না।
কালিহাতী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহরিয়ার রহমান বাংলানিউজকে জানান, প্রকল্পটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের। এ কারণে এসব কিছু তদারকির দায়িত্বও তাদের। আর বাংলা ড্রেজারের বিষয় নিয়ে আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এখন পর্যন্ত কেউ বাংলা ড্রেজারের বিষয়ে অভিযোগ করেনি।
টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, খনন কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এশিয়ান ড্রেজিং লিমিটেড কোনোভাবেই সাব ঠিকাদার দিয়ে নদী খনন করতে পারবে না। তারা যদি সাব ঠিকাদার দিয়ে নদী খনন কাজ করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলা ড্রেজার বসিয়ে নদী খননের কথা স্বীকার করে নিয়ে তিনি আরও জানান, মির্জাপুর অংশে ২১ কোটি ৯১ লাখ টাকা এবং কালিহাতী অংশে এশিয়ান ড্রেজিং লিমিটেড কাজ করছে ৫৪ কোটি ২৪ লাখ টাকার। এর আগে ১৪টি প্যাকেজের কাজে ৯০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
সাব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘মা’ এন্টার প্রাইজের মালিক সুজন খান বাংলানিউজকে জানান, এশিয়ান ড্রেজিং লিমিটেডের বাসাইল উপজেলার বাদল মিয়ার সঙ্গে তার ব্যবসায়ীক একটি সম্পর্ক রয়েছে। এ কারণে বাদল মিয়া তাকে জানিয়েছেন, আপনার প্রতিষ্ঠান ‘মা’ এন্টার প্রাইজকে সাব ঠিকাদার দিয়ে নদী খননে সহযোহিতা চাই। তবে এ খনন কাজে সাব ঠিকাদার দেওয়া যাবে কিনা এ বিষয়ে তার জানা নেই।
এ বিষয়ে এশিয়ান ড্রেজিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামীম রেজার ব্যবহৃত মুঠোফোনে বারবার কল করা হলেও ফোনটি রিসিভ হয়নি।
এশিয়ান ড্রেজার লিমিটেডের সাইট ম্যানেজার মো. শাফি বাংলানিউজকে জানান, নদী খননের কাজ আমরা পাওয়ার পর প্রায় পুরো কাজ মা এন্টারপ্রাইজকে সাব কন্ট্রাক্ট দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে জিরো থেকে ৯ কি.মি আমরা (এশিয়ান ড্রেজিং লিমিটেড) কাজ করছি।
অনিয়মের বিষয়ে কোনো প্রকার মন্তব্য করতে রাজি হননি এশিয়ান ড্রেজার লিমিটেডের এ সাইট ম্যানেজার।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০২০
এইচএডি/