পাবনা (ঈশ্বরদী): জীবন থেমে থাকে না, তবে সংগ্রাম চলে অবিরত। এরই নাম জীবন সংগ্রাম।
জীবনের শেষ সময় এসেও গান ছাড়তে পারেনি এই প্রতিবন্ধী কণ্ঠশিল্পী রইজ। সপ্তাহের শনি ও শুক্রবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে আপন মনে গান গাইতে থাকেন। প্রতিদিন মানুষ বেড়াতে আসেন পাকশির পদ্মা নদীর তীরে। অনেক মানুুষই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ-লালন শাহ সেতুর নিচে এসে রইজের সুরেলা কণ্ঠে গান উপভোগ করেন।
শুক্রবার (৮ জানুয়ারি) সকাল ১০টায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে আপন মনে একতারা বাজিয়ে গান গাইছিলেন রইজ উদ্দিন। তবে বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে মানুষ আর হাটে লোকগান শুনতে ইচ্ছুক নয়। নতুন গান তুললে তা শুনে টাকা কেউ দেয় কেউ দেয় না। তবুও একটানা গান গেয়ে চলছে ‘মায়ের একধার দুধের দাম, কাটিয়া গায়ের চাম/পাঁচ তলাতে শান্তি নাইরে আছে গাছতলায়/ওকি গাড়িয়াল ভাই/চাতক বাচে ক্যামনে। পুরোনো দিনের এসব গান তার সুরেলা কণ্ঠে শুনে অনেকেই ৫/১০ টাকা দিচ্ছিলেন। আগে সপ্তাহের অন্যদিনগুলোতে ঈশ্বরদী উপজেলার ইপিজেড মোড়, রুপপুর মোড়, দাশুড়িয়া ট্রাফিক মোড়, অরনকোলা গরু হাট, এলাকায় ঘুুুরে ঘুরে গান গাইতেন।
রইজের বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। বাবার মৃত্যুর পর গান গেয়ে টাকা আয় করে অনেক কষ্টে তিনি ৩ বোনের বিয়ে দিয়েছেন। এখন বয়সের ভারে আর হয়ে ওঠে না। যা আয় করেন, তা দিয়ে চলে সংসার, আর ছোট ছেলের পড়ালেখার খরচ।
রইজ উদ্দিন ঈশ্বরদী উপজেলার লক্ষিকুন্ডা ইউনিয়নের ফকির মার্কেট এলাকার মৃত রাজমিস্ত্রি মৃত হাকিম উদ্দিন শেখের বড় ছেলে। তারা ৩ ভাই ৪ বোন। এদের মধ্যে সেই বড়। আর রইজ উদ্দিনের ২ ছেলে ও স্ত্রী রয়েছে। বড় ছেলে জসিম উদ্দিন শেখ (২০) বিয়ে করে সংসার শুরু করে আলাদা থাকেন। ছোট ছেলে শিমুল উদ্দিন (১৪) গ্রামের হাইস্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ালেখা করছে।
রইজ উদ্দিনের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা যায়, যখন মাত্র দেড় বছর, তখন রইজ উদ্দিনের টাইফয়েড জ্বরে মাথায় ফোঁড়া হয়। ভালো চিকিৎসা করা সম্ভব হয়নি তখন। ওই অসুখের প্রতিক্রিয়া চোখের জ্যোতি কমে যায়। মাত্র ৭ বছর বয়স যখন হলো, তখন তার স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছা হলেও চোখের স্বল্প দৃষ্টির কারণে সম্ভব হয়নি। ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রইজের বয়স মাত্র ১০ বছর। তখন বাড়িতে একা বসে বসে রেডিওতে গান শুনতেন রইজ উদ্দিন। মেধা ভালো থাকার কারণে গানগুলো সহজেই মুখস্ত হয়ে যেত। সুন্দর কণ্ঠে সেই গান অন্যদের শোনাতেন। তখনও তিনি ভাবেননি এটাই তার পেশা হয়ে যাবে।
কেমন আছেন তিনি? জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি বেশ ভালোই আছি! তবে আমি কারো কাছে সাহায্য প্রত্যাশী নন। সারাদিনে ২ থেকে ৩শ’ টাকা আয় করেন। অতঃপর মুচকি হাসি দিয়ে বলেন, শুক্রবার একটু আয় বেশি হয়। তবে দুঃখ করে বললেন, ‘এখন আর পুরোনো একতারা দিয়ে গান আর কেও শুনতে চাই না। বদলে গেছে দিন, আধুনিক হয়েছে সবকিছু। তবে নতুন একটা একতারা হলে ভালো হয়’।
ঈশ্বরদী উপজেলায় যেকোনো নির্বাচন হলে ডাক পড়তো রইজ বয়াতির। পাড়া আর মহল্লা, গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে, অনেকে জনপ্রতিনিধি হয়েছেন, বিপুল ভোটে নির্বাচিতও হয়েছেন। তবে পরে আর কেউ আর খোঁজ রাখেনি এই শিল্পীর। শেষ জীবনে এসে তবুও কোনো অভিমান নেই শিল্পী রইজ উদ্দিনের।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৮, ২০২১
এনটি