ঢাকা: গণভবনেও ‘মশা গান শোনাচ্ছে’ মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার মেয়রদের সর্তক করার পর কয়েকমাস বেশ স্বস্তিতে কাটিয়েছিলেন নগরবাসী। কিন্তু আবারও রাজধানীতে মশার উপদ্রব বেড়েছে।
রাজধানীর শনির আখড়া এলাকার বাসিন্দা ফজলুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী মেয়রদের বলার পর মাঝখানে কয়েকমাস মশা ছিল না বললেই চলে। এখন আবার মশার কামড়ে জীবন অতিষ্ঠ। মশা এত বেশি বেড়েছে দলবেঁধে কামড়ায়।
ক্ষোভ প্রকাশ করে ফজলুর রহমান বলেন, গেলো মার্চে মশার উপদ্রব যখন চরম আকার ধারণ করেছিলে তখন মশা নিয়ন্ত্রণ করতে প্রধানমন্ত্রীকে নির্দেশ দিতে হয়েছিল। তারপর কয়েকমাস মশা একেবারে ছিল না বললেই চলে। এখন আবার বেশ কয়েক সপ্তাহ থেকে মশার উপদ্রব চরম আকার ধারণ করেছে। এমন কী হলো যে এখন আবার এত মশা। তার মানে সংশ্লিষ্টরা ঠিকমতো কাজ করছে না কিংবা ভালো ওষুধ ছিটাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীকেই কেন বলে বলে কাজ করাতে হবে?
গেলো মার্চ মাসের ৩১ তারিখে মশার প্রাদুর্ভাব নিয়ে ঢাকার মেয়রদের সতর্ক করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, মশা সংগীত চর্চা করছে। গুনগুন করে কানের কাছে বেশ গান গাচ্ছিল।
রাজধানীতে মশার উপদ্রব বৃদ্ধি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মঙ্গলবার (১২ জানুয়ারি) সচিবালয়ে স্থানীয় সরকার,পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, মশা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে কিনা আমি জানি না। তবে ইদানীং কিছু কিছু মশা দেখা যাচ্ছে। আমার নিজের বাসাতেও মাঝে মধ্যে দুই-একটা মশা দেখি। যেটা কিছুদিন দেখিনি।
রাজধানীর গুলশানের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট শেখ জাহাঙ্গীর জানান, সেখানে মশার উপদ্রব ব্যাপক বেড়েছে।
গুলশানের কয়েকজন বাসিন্দা বাংলানিউজকে বলেন, মশার যন্ত্রণায় তারা অতিষ্ঠ। ঝাঁক বেঁধে মশা কামড়ায়, থাপ্পড় দিলে একসঙ্গে অনেকগুলো মশা পড়ে। আর এখানকার মশাগুলো আকারে বেশ বড়।
আব্দুল্লাহ আল মামুন নামে একজন ভাসমান চা বিক্রেতা বাংলানিউজকে বলেন, কোথাও দাঁড়াতে পারি না মশার কারণে। হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে মশা এমনভাবে কামড় দেয় যেনে হয় শরীরে পিঁপড়া কামড়াচ্ছে। মশার জ্বালায় টেকা যায় না।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও মিরপুরের বাসিন্দাদের বরাত দিয়ে বাংলানিউজের সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্ট শোয়েব মিথুন জানান, এসব এলাকায় মশার উপদ্রব মারাত্মকভাবে বেড়েছে।
যাত্রাবাড়ী রসুলপুরের বাসিন্দা আব্দুল কাদের বাংলানিউজকে বলেন, মশা এত বেশি মনে হয় উড়িয়ে নিয়ে যাবে। ২/১ মিনিট চুপ করে বসলেই মশা ঝাঁক বেঁধে কামড়াতে শুরু করে।
মিরপুরের বাসিন্দা আলমগীর হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, মশা অনেক বেড়েছে। রাস্তায় চুপ করে একটু দাঁড়ালে মহূর্তেই হাতে-পায়ে মশা দলবেঁধে আক্রমণ করে।
জুরাইন, কদমতলী, শ্যামপুর এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে বাংলানিউজের সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্ট দেলোয়ার হোসেন বাদল জানান, এসব এলাকাতেও মশার উপদ্রব বেড়েছে।
এই এলাকার বাসিন্দারা বাংলানিউজকে বলেন, জুরাইন, কদমতলী, শ্যামপুর এলাকায় মশার উপদ্রব অনেক বেশি। সন্ধ্যা হলে বাইরে থাকা তো দূরের কথা ঘরেই থাকাই মুশকিল হয়ে পড়ে। কানের কাছে গান গায়। ৫২, ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডে নিয়মিত ওষুধ ছিটানো হচ্ছে না এবং ওষুধ ঠিক মতো কাজ করছে না।
রাজধানীর রামপুরার বাসিন্দাদের বরাত দিয়ে বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট আবাদুজ্জামান শিমুল জানান, সেখানকার মশার উপদ্রব বেড়েছে।
রামপুরার বাসিন্দা নবম শ্রেণির ছাত্রী ফারিয়া সুলতানা বাংলানিউজকে বলেন, ঘরে-বাইরে প্রচুর মশা। মাঝে মধ্যে সিটি করপোরেশন থেকে ওষুধ ছিটানো হয়। ওই ওষুধ ছিটানোর পর মশাগুলো মরে না। বরং বাইরে মশাগুলোও ঘরে আইসা পড়ে।
বাংলানিউজের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট মহসিন হোসেন জানান, রাজধানীর মগবাজার চৌরাস্তা থেকে পেয়ারাবাগ, নয়াটোলা, চেয়ারম্যান গলি, মগবাজার বিটিসিএল কলোনি, পূর্ব নয়াটোলা, মধুবাগ এলাকার মানুষ মশার উপদ্রবে অতিষ্ট।
বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট এসএমএ কালাম জানান, রাজধানীর শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, তালতলায় মশার উপদ্রব বেড়েছে।
শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা নার্গিস কবির বাংলানিউজকে বলেন, দিনেও মশা প্রচুর কামড়ায়। মাঝে মধ্যে সিটি করপোরেশন মশার ওষুধ দিলেও কোনো কার্যকারিতা নেই, মশা কমে না।
বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট হোসাইন সাগর জানান, রাজধানীর হাতিরপুল এলাকায় মশার উপদ্রব বেড়েছে।
এই এলাকায় মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের তৎপরতা কম বলে অভিযোগ করেন এলাকাবাসী।
বাংলানিউজের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ইসমাইল হোসেন জানান, সম্প্রতি পুরান ঢাকার কলতাবাজার এলাকায় মশার উপদ্রব কিছুটা বেড়েছে। কয়েক সপ্তাহ আগেও এখানে এত মশা ছিল না।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে বাংলানিউজের করেসপন্ডেন্ট রেজাউল করিম রাজা জানান, ধানমন্ডির বিভিন্ন এলাকায় মশার উপদ্রব অনেকটা বেড়েছে।
মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে আগামী সপ্তাহে সিটি করপোরেশনসহ ডেঙ্গু বিষয়ক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা ডাকা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মশার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি মেনে নেন ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (ব্রি. জে.) জোবায়দুর রহমান। শীতের ঋতুগত কারণে এবং ডিএনসিসির খাল পরিষ্কার এর জন্য অন্যতম কারণ মনে করছেন এই কর্মকর্তা।
ব্রি. জে. জোবায়দুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, শীতের মৌসুমে ঋতুগত কারণে মশা বেড়েছে। কারণ এডিস যেমন পরিষ্কার জমা পানিতে হয় তেমনি কিউলেক্স মশা নোংরা, অপরিষ্কার পানিতে হয়। শীতকালে এখন যে মশা সেটি মূলত কিউলেক্স মশা। অনেক জলাশয় শীতকালে শুকিয়ে যাওয়ায় সেখানে কিউলেক্স মশা জমছে। আবার বর্ষাকালে জলাশয়ের পানি যেমন বহমান থাকে শীতকালে কিন্তু তেমন না। তাই মশা বেড়েছে।
‘পাশাপাশি সম্প্রতি আমরা ওয়াসার থেকে খালগুলো বুঝে পেয়েছি। এগুলো আমরা পরিষ্কার করছি। এসব খাল থেকে কচুরিপানা পরিষ্কার করা হচ্ছে। এসব খাল ও কচুরিপানায় যেসব মশা থাকতো তার একটি অংশ কিন্তু উড়ে লোকালয়ে যাচ্ছে। এটাও একটা কারণ। ’
মশক নিধনে ডিএনসিসির বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে জোবায়দুর রহমান বলেন, করোনার মধ্যে লকডাউনেও আমরা পাঁচবার চিরুনি অভিযান পরিচালনা করেছি। এর জন্য এবছর এডিসের প্রকোপ কিন্তু গতবারের মতো ছিল না। তেমনি কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণেও আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
তিনি আরো বলেন, ইতোমধ্যে ১০টি ‘মিক্সড ব্লোয়ার’ কেনার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়েছে। অল্পকিছু দিনের মধ্যেই এগুলো আমরা হাতে পাবো। ১০টি অঞ্চলের জন্য ১০টি মিক্সড ব্লোয়ার কেনা হচ্ছে। এগুলো দিয়ে ওষুধ ছিটানো শুরু হলে আরও ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২০
এমইউএম/এএ