ঢাকা: রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় তার বান্ধবী নেহা (২৫) ও অজ্ঞাতপরিচয় আরেক আসামি পলাতক রয়েছেন। এ ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থীর পরিবারের দায়ের করা মামলায় দুই আসামিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
এর আগে শনিবার (৩০ জানুয়ারি) নিহত তরুণীর সহপাঠী আরাফাত (২৮) ধানমন্ডিতে সিটি জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। ইতোমধ্যে তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে বলে জানা গেছে তবে, কোথায় তাকে দাফন করা হয়েছে সেটিও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। প্রয়োজনে তার মরদেহ উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত করার আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ বলছে, এ ঘটনায় মামলার এজাহারনামীয় এক নম্বর আসামি মর্তুজা রায়হান চৌধুরী (২১) ও দুই নম্বর আসামি নুহাত আলম তাফসীরকে (২১) গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া মামলার এজাহারনামীয় আরেক আসামি আরাফাত (২৮) মারা গেছেন বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। এখন এই মামলার পলাতক দুই আসামি নেহা ও অজ্ঞাতপরিচয় যুবককে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
তাদের খুঁজে পেলে গত ২৮ জানুয়ারি রাতে উত্তরা তিন নম্বর সেক্টরের ব্যাম্বো শ্যুটস (Bamboo Shoot) করা মদের পার্টি ও পরবর্তীতে মোহাম্মদপুরের ওই বাসায় ধর্ষণের ঘটনার বিষয় অনেক তথ্য জানা যাবে। এছাড়াও পূর্বপরিকল্পিত পার্টির আয়োজনে সেখানে মদের ব্যবস্থা কে করেছে এবং মদের সরবরাহকারীকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
এ বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুল লতিফ বাংলানিউজকে বলেন, এ ঘটনায় গ্রেফতার দু’আসামিকে আদালতে সোপর্দ করলে প্রত্যেকের ৫ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আমরা ঘটনার বিষয় তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি। মামলা এখন তদন্তাধীন।
তিনি বলেন, নিহত তরুণীর পলাতক বান্ধবী নেহা ও তার সঙ্গে থাকা ওই যুবককে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি অতিরিক্ত মদ পানে মারা যাওয়া আরাফাতের কবর শনাক্তে আমরা অভিযান শুরু করেছি। এছাড়াও আসামি ও নিহত তরুণী মোবাইলফোন ও ফেসবুক তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। সেখানে তারা কিভাবে যোগাযোগ করে পার্টিতে গিয়েছিল তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী গত বৃহস্পতিবার ২৮ জানুয়ারি উত্তরার ওই রেস্টুরেন্টে নিহত তরুণীসহ মোট ৫ জন একটি পার্টিতে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে তারা বাইরে থেকে মদ এনে তা অতিমাত্রায় তারা সেবন করেছিলেন। এতে মেয়েটি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। পরে তার বান্ধবী নেহা ও বন্ধু আরাফাত অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে তাদের সহপাঠী আরাফাত মারা যায়। অতিরিক্ত মদ পানে আরাফাতের মৃত্যু হয়েছে বলে সিটি জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। তবে, আরাফাতের মরদেহ কোথায় দাফন করা হয়েছে তা জানতে তার পরিবার ও হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। যেহেতু ভুক্তভোগী তরুণীর পরিবাবের দায়ের করা মামলায় আরাফাত এজাহারনামীয় আসামি তাই তদন্তের স্বার্থে কবর থেকে তার মরদেহ উত্তোলনের জন্য আবেদন করা হবে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আরও বলেন, গ্রেফতার দু’আসামি মর্তুজা রায়হান চৌধুরী ও নুহাত আলম তাফসীর গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার বিষয়ে অনেক তথ্য দিয়েছে।
তাদের ভাষ্যমতে, নিহত তরুণী ও রায়হান একইসঙ্গে পড়াশোনা করতো। আগে থেকেই তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। গত ২৮ জানুয়ারি বিকেলে তারা দেখা করতে বের হন। ওইদিন বিকেলে প্রথমে তারা হাতিরপুলে মোতালেব প্লাজার সামনে একত্রিত হন। সেখানে তাদের বন্ধু আরাফাতও ছিলেন। তখন আরাফাত তাদেরকে গুলশানে একটি রেস্টুরেন্টে পার্টির জন্য দাওয়াত দেয়। এতে তারা তিনজন লালমাটিয়ায় আরাফাতের বাসায় যায়। সেখানে আরাফাত তার স্কুটি রেখে একটি উবার ক্যাব ঠিক করেন। ঠিকানা পরিবর্তন হওয়ায় তারা গুলশান না গিয়ে উত্তরার ব্যাস্বো শ্যুটস রেস্টুরেন্টে যায়। আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন ওই তরুণীর বন্ধু নেহা ও তার সঙ্গে আরও এক যুবক। ওই রেস্টুরেন্টে তারা পাঁচজন একসঙ্গে মদ পান করেন। মদ সরবরাহ করেছিলও নেহার সঙ্গে থাকা ওই যুবক।
জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা আরও জানান, মদ পানের একপর্যায়ে নেহা অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং রেস্টুরেন্টের টয়লেটে গিয়ে বমি করেন। তখন নেহা ও তার বন্ধু চলে যায়। রেস্টুরেন্টে আরাফাত, রায়হান ও ওই তরুণী মদ পান করতেই থাকেন। একপর্যায়ে ভুক্তভোগী তরুণীও রেস্টুরেন্টের টয়লেটে গিয়ে একাধিকবার বমি করেন। সেই অবস্থা দেখে রায়হান ও আরাফাত ওই তরুণীকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়। একটি উবার ক্যাব নিয়ে ওই তরুণী ও রায়হানকে গুলশান-২ এ নামিয়ে দেয় আরাফাত। অতিরিক্ত মদপানের কারণে তরুণী তার বাসায় যেতে চায় না। পরে সেখান থেকে ওই তরুণী ও রায়হান চলে যায় মোহাম্মদপুর হোমস লিমিটেডের ৯ নম্বর বিল্ডিংয়ে তরুণীর বান্ধবী তাফসীরের বাসায়। তরুণী ওই বাসায় গিয়েও একাধিকবার বমি করেন। সেসময় তরুণীর বান্ধবী তাফসীর ও বন্ধু রায়হান মিলে বমি পরিষ্কার করেন। এরপর রাতে রায়হান ও ভুক্তভোগী তরুণীকে বাসার এক কক্ষে রেখে তাফসীর অন্য কক্ষে চলে যায়। পরে রায়হান ওই তরুণীর সঙ্গে একাধিকবার শারীরিক সম্পর্ক করেন। পরদিন শুক্রবার (২৯ জানুয়ারি) তরুণী আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং বার বার বমি করতে থাকেন। তরুণীর অবস্থার অবনতি ঘটলে শুক্রবার মধ্যরাতে রায়হান তার বন্ধু কোকোকে মোবাইলফোনে বিষয়টি জানায়। পরে কোকো এসে প্রথমে তরুণীকে কল্যাণপুরের ইবনে সিনা হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) না থাকায় তরুণীকে ধানমন্ডির আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে আইসিইউতে রাখা হয় ভুক্তভোগী তরুণীকে। তখন রায়হান ভুক্তভোগী তরুণীর বাবাকে মোবাইলফোনে বিষয়টি জানায়। খবর পেয়ে তরুণীর বাবা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে মেয়ের চিকিৎসার খবর নেন।
এদিকে রায়হান তাকে সব খুলে বলেন। শনিবার (৩০ জানুয়রি) মধ্য রাতে আরাফাতের মৃত্যুর আগেই ভুক্তভোগী তরুণীর বাবা মোহাম্মদপুর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ৫ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। পরদিন রোববার (৩১ জানুয়ারি) ভুক্তভোগী তরুণী চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) রওশানুল হক সৈকত বাংলানিউজকে বলেন, গ্রেফতার দু’আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। আমরা ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহের চেষ্টা করছি।
বাকি আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে পাশাপাশি নিহত তরুণীর বন্ধু আরাফাতের দাফনের বিষয়ে তথ্য জানার চেষ্টাও চলছে বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. হারুন অর রশিদ বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে শুনেছি নেহার এক বন্ধু বিমানবন্দর থেকে মদ এনে উত্তরার ওই রেস্টুরেন্টে বসে সেবন করেছিলেন। আমরা সেই ছেলের পরিচয় এখনো পাইনি। তাকে খোঁজা হচ্ছে। সেই মদ পানের কারণেই কিছু হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এছাড়া মদ পান করার কারণে বিষক্রিয়া হয়েছে কিনা তা আমরা তদন্ত করছি।
মামলার এজাহারে যা উল্লেখ করা হয়:
ভুক্তভোগী মেয়েটির বাবা বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় ৫ আসামির নামোল্লেখ করে মামলা একটি করেন। মামলায় ভুক্তভোগী তরুণীর বন্ধু মর্তুজা রায়হান চৌধুরীকে (২১) ধর্ষণকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অন্য চার আসামির মধ্যে তিনজন হলেন-নুহাত আলম তাফসীর (২১), আরাফাত (২৮) ও নেহা (২৫)। বাকি একজন অজ্ঞাতপরিচয় যুবক। তাদের সবাইকে ধর্ষণের সহযোগী হিসেবে বলা হয়েছে।
এজাহারে বলা হয়েছে, গত ২৮ জানুয়ারি বিকেল ৪টায় মর্তুজা রায়হান ওই তরুণীকে মিরপুর থেকে আসামি আরাফাতের বাসায় যায়। বাসায় স্কুটার রাখেন আরাফাত। ওই তরুণী ও রায়হান একসঙ্গে উবারে করে তারা উত্তরার ওই রেস্টুরেন্টে যায়। সেখানে আগে থেকেই আরেক আসামি নেহাসহ ও আরও একজন সহপাঠী (তরুণ) আগে থেকেই উপস্থিত ছিল। সেখানে আসামিরা ওই তরুণীকে জোর করে ‘অধিক মাত্রায়’ মদপান করায়। একপর্যায়ে ওই ভুক্তভোগী অসুস্থবোধ করলে রায়হান তাকে মোহাম্মদপুরে তার এক বান্ধবীর বাসায় পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে ওই তরুণীকে একটি রুমে নিয়ে রায়হান তাকে ধর্ষণ করেন। ধর্ষণের পর রাতে ওই তরুণী অসুস্থবোধ করে ও বমি করলে তিনি তার অসিম খান কোকো নামে তার আরেক বন্ধুকে ফোন দেয়। সেই বন্ধু পরদিন এসে ওই তরুণীকে প্রথমে ইবনে সিনা ও পড়ে আনোয়ার খান মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করেন। দুইদিন লাইফসাপোর্টে থাকার পর রোববার (৩১ জানুয়ারি) তার মৃত্যু হয়।
শিক্ষার্থীর মরদেহ ময়নাতদন্তে ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। এ বিষয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সেলিম রেজা বাংলানিউজকে বলেন, রোববার নিহত ছাত্রীর মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়। রিপোর্ট হাতে পেলে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে। এছাড়া মদপান, যৌন উত্তেজক ওষুধ অথবা অন্য কিছু খেয়েছিল কিনা সব রিপোর্টের ওপর নির্ভর করছে।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০১, ২০২১
এসজেএ/এএটি