গাইবান্ধা: সাইনবোর্ডে রমেশ সুইটস লেখা দেখে যে কেউ বুঝবে এখানে মিষ্টি পাওয়া যায়। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়বে কাচঘেরা তাকে করে সাজানো ক্ষীরমোহন, মালাইচপ, হাঁড়িভাঙ্গা, রসগোল্লা, ড্রাইগোল্লা, লেঞ্চা, ছানার জিলাপিসহ নানা নামের হরেকরকম মিষ্টি।
অনেকে আবার দু’চার প্যাকেট সঙ্গে করেও নিয়ে যাচ্ছেন। এভাবেই চলে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। বাহারী মিষ্টির ভিড়ে বয়োবৃদ্ধ সবারই পছন্দ রসমঞ্জরী।
গাইবান্ধা শহরের মূল সড়ক ডিবি রোডের ১ নম্বর ট্রাফিক মোড় থেকে উত্তরে সার্কুলার রোডে একশ মিটার এগুলেই বাম পাশে অবস্থিত ঐহিত্যবাহী রমেশ সুইটস ছাড়াও শহরের কাচারি বাজারের গাইবান্ধা মিষ্টান্ন ভান্ডারসহ স্থানীয় আরও কয়েকটি মিষ্টির দোকানেরও একই চিত্র।
মিষ্টির দোকানগুলোর নানা পদের মিষ্টির ভিড়ে সবার কেন রসমঞ্জরীই বেশি পছন্দ, তা জানতে কয়েকজন ভোজনরসিকের সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের সঙ্গে।
গাইবান্ধা পৌর শহরের ৩ নং ওয়ার্ডের সুখনগর এলাকার বাসিন্দা সামিউল ও তার বন্ধু একই এলাকার স্মরণ বাংলানিউজকে বলেন, রসমঞ্জরী বলতে আমরা ঘন লালচে দুধে তৈরি রস-ক্ষীরে ডোবানো মার্বেলের মত গোলাকার ছানার তৈরি মিষ্টিকে বুঝি। অন্যান্য মিষ্টি আর রসমঞ্জরীর মধ্যে পার্থক্যটা মূলত বিশেষ ওই রস-ক্ষীরে। এ রস-ক্ষীরসহ ছোট মিষ্টিগুলো মুখে নিয়ে অতুলনীয় যে স্বাদ মেলে, তা অন্যসব মিষ্টিতে পাওয়া যায় না। এ কারণেই সবার পছন্দের শীর্ষে থাকে এ রসমঞ্জরী।
গাইবান্ধা সদরের সাহাপাড়া ইউনিয়নের বিষ্ণুপুর গ্রামের বাসিন্দা রহিম খান বাংলানিউজকে জানান, রসমঞ্জরীর কোনো তুলনা হয়। যা দেখলেই জিভে জলে এসে যায়। ক্ষীর-রসে ডোবানো ছানার তৈরি ছোট ও নরম মিষ্টিগুলো শিশু থেকে বৃদ্ধ- সবারই প্রিয়। বিশেষ করে সকালের নাস্তায় পরোটার সঙ্গে রসমঞ্জরীর স্বাদ ভোলা দায়। যে কারণে এর খ্যাতি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়েছে। দেশের ভোজন রসিকদের কাছে গাইবান্ধা এখন রসমঞ্জরীর জেলা হিসেবে পরিচিত।
রমেশ সুইটসের পরিচালক বাদল ঘোষ বাংলানিউজকে বলেন, রসমঞ্জরী গাইবান্ধা জেলার একটি ব্রান্ডিং পণ্য। ১৯৪৮ সালে রমেশ ঘোষ গাইবান্ধায় প্রথম এ ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৮৯ সালে তার মৃত্যুর পর দুই ছেলে রনজিত কুমার ঘোষ ও পরিজিত কুমার ঘোষ ব্যবসার হাল ধরেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে রনজিত কুমার ঘোষ আমার ভগ্নিপতি। সেই সূত্রে আমরা ব্যবসা পরিচালনা করে আসছি। বর্তমানে রসমঞ্জরীর যে উৎকর্ষতা-আধুনিকতা, তা রমেশ ঘোষের হাত ধরেই শুরু এবং সেই ধারায় গাইবান্ধায় ২০ থেকে ২৫টি দোকানে রমেশ ঘোষের পদ্ধতিতেই রসমঞ্জরী তৈরি হচ্ছে।
অতীত ও বর্তমানে রসমঞ্জরীর স্বাদের তুলনা করে তিনি বলেন, রসমঞ্জরীর গুণগত মান ও স্বাদ অক্ষুণ্ন রাখতে যদিও আমরা বদ্ধ পরিকর। তারপরও আমরা তা পরছি না। কারণ রসমঞ্জরী তৈরির মূল কাঁচামাল হচ্ছে দুধ। বর্তমানে বাজারে যে দুধ পাওয়া যায়, তাতে ননির পরিমাণ খুব কম। এ কারণে প্রবীণ কাস্টমারদের অনেকে বলেন, রমেশ ঘোষের সময়ে রসমঞ্জরীর যে স্বাদ পাওয়া যেত, তেমন স্বাদ এখন আর পাওয়া যায় না।
রসমঞ্জরীর চাহিদা সম্পর্কে তিনি বলেন, দেশে রসমঞ্জরীর চাহিদা সব সময় থাকলেও শীত মৌসুমে তা বাড়ে। এসময় বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে শীতপ্রধান দেশগুলোতে থাকা প্রবাসী আত্মীয়-স্বজনদের জন্য রসমঞ্জরী পাঠান আপনজনেরা। শীতে রসমঞ্জরী দীর্ঘ সময় ভালো থাকে। কিন্তু গ্রীস্মকালে সাত/আট ঘণ্টা পর এটা নষ্ট হতে থাকে। প্রতি কেজি রসমঞ্জরীর দাম রাখা হচ্ছে ৩০০ টাকা। এছাড়া খুচরায় এক প্লেট রসমঞ্জরী ৫০ টাকায় বিক্রি করা হয়।
রমেশ সুইটসের রসমঞ্জরী তৈরির কারিগর গোবিন্দ চন্দ্র সরকারের বাড়ি জেলার সাদুল্যাপুর উপজেলায়। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, দীর্ঘ প্রায় তিন যুগ ধরে এ প্রতিষ্ঠানে রসমঞ্জরী তৈরি করছি। এ কারখানায় হাতের স্পর্শ ছাড়া প্রতিদিন ৮০ থেকে ৯০ কেজি রসমঞ্জরী তৈরি হয়ে থাকে।
তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রথমে দুধ জাল দিতে তাতে টক পানি মিশিয়ে ছানা বের করতে হয়। এরপর পাতলা কাপড়ে ছেঁকে ছানাকে পানিমুক্ত করতে হয়। ওই ছানার সঙ্গে পরিমাণমত ময়দা মিশিয়ে মেশিনে গুটি তৈরি করতে হয়। ছোট ছোট মার্বেল আকৃতির এ মিষ্টি চিনির সিরায় ফেলে কিছুক্ষণ জ্বালাতে হবে। এর পর আলাদা একটি পাত্রে চিনি ও এলাচের গুড়া মেশানো দুধ দীর্ঘ সময় জ্বাল দিয়ে ঘন করে ক্ষীর তৈরি করতে হবে। শেষে চিনির সিরায় জ্বালানো ছোট ছোট ময়দা-ছানার বলগুলো ছাঁকনি দিয়ে তুলে ঘন ক্ষীরে ছাড়লেই সুস্বাদু রসমঞ্জরী তৈরি হয়ে যাবে।
কেউ চাইলেই বাড়িতে রসমঞ্জরী তৈরি করতে পারেন বলে জানান এ কারিগর। তিনি বলেন, গাইবান্ধার রসমঞ্জরী সবার প্রিয় হলেও ইচ্ছা করলেও সব সময় খেতে পারেন না জেলার বাইরে বসবাসকারীরা। তারা চাইলে নিজ বাড়িতেই রসমঞ্জরী তৈরি করতে পারেন। এক কেজি রসমঞ্জরী তৈরিতে আড়াই লিটার দুধ থেকে ৩০০ গ্রাম ছানা বের করতে হবে। ওই ছানার সঙ্গে মেশাতে হবে ৫০ গ্রাম ময়দা। এরপর এ মিশ্রণ থেকে ছোট গোলাকার মার্বেলের মত বল বানিয়ে দুই কেজি চিনিতে তৈরি সিরায় আধা ঘণ্টা জ্বাল দিতে হবে। এবার আরেকটি পাত্রে দুই লিটার দুধে এলাচ গুড়া ও চিনি দিয়ে দুই ঘণ্টা ধরে জ্বাল দিয়ে ক্ষীর বানাতে হবে। চিনির সিরা থেকে বলগুলো তুলে ওই ক্ষীরে ছাড়লেই তৈরি হয়ে যাবে মাজাদার রসমঞ্জরী।
শহরের কাচারী বাজারে গাইবান্ধা মিষ্টান্ন ভান্ডারে রসমঞ্জরী কিনতে আসা জাভেদ হোসেন বাংলানিউজের বলেন, বাসার সবাই, বিশেষ করে বাচ্চারা রসমঞ্জরী অত্যন্ত পছন্দ করে। ওদের জন্য ফ্রিজে সব সময় রসমঞ্জরী রাখতেই হয়। এছাড়া জেলার বাইরে কোনো আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গেলে সঙ্গে রসমঞ্জরী নিতেই হয়। অনেকে গাইবান্ধায় কাজে বা ঘুরতে এসে খাওয়ার পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের জন্যসঙ্গে নিয়ে যান রসমঞ্জরী।
গাইবান্ধা মিষ্টান্ন ভান্ডারের সত্ত্বাধিকারী কাজী হারুনুর রশিদ সেলিম বাংলানিউজকে জানান, আমাদের প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন নামের-স্বাদের মিষ্টি-সন্দেশ তৈরি করা হয়। এর মধ্যে রসমঞ্জরীর চাহিদাই বেশী। চাহিদা অনুযায়ী প্রতিদিনি গড়ে দুই মণ রসমঞ্জরী তৈরি করে বিক্রি করি বিভিন্ন উৎসব ও অনুষ্ঠানে এর চাহিদা বেড়ে যায়। এর সুনাম ও মান অক্ষুণ্ন রাখতে আমরা বদ্ধ পরিকর।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২, ২০২১
এসআই