ঢাকা: শুধু নামাজ আদায় নয়, মসজিদ হবে গবেষণা, ইসলামী সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র। হারিয়ে যাওয়া ইসলামের চিরায়ত এই ঐতিহ্যকে ধারণ করে দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে দৃষ্টিনন্দন ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সংস্কৃতি কেন্দ্র নির্মাণ করছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার।
মডেল মসজিদ ও সংস্কৃতি কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, মুসলিম বিশ্বের এই প্রথম কোনো দেশের সরকার প্রধান একসঙ্গে ৫৬০টি মসজিদ নির্মাণ করছে। এর আগে কোনো মুসলিম শাসক বা সরকার প্রধান এক সঙ্গে এতগুলো মসজিদ নির্মাণ করেননি।
গত কয়েকদিন সরেজমিনে বিভিন্ন জেলা ঘুরে দেখা গেছে, সারা দেশে এসব মডেল মসজিদের নির্মাণ কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। সিরাজগঞ্জ ও রংপুর জেলা মডেল মসজিদ ও সংস্কৃতি কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, এই দুইটি মসজিদের ৯০ শতাংশ কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক ফারুক আহমেদ বলেন, সিরাজগঞ্জ জেলার মোট ১০টি মসজিদের মধ্যে জেলা মডেল মসজিদ ও একটি উপজেলা মসজিদ নির্মাণ কাজ আগামী মার্চের শুরুতে সম্পন্ন হবে।
সারাদেশে মডেল মসজিদ ও সংস্কৃতি কেন্দ্র নির্মাণের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. নজিবর রহমান বলেন, মুজিববর্ষে ১৭০টি মডেল মসজিদ ও সংস্কৃতি কেন্দ্র উদ্বোধন করা হবে।
নির্মাণাধীন রংপুর জেলা মসজিদ পরিদর্শনকালে তিনি বলেন, আগামী এপ্রিলে ৫০টি মডেল মসজিদ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেপ্টেম্বরে ৬০টি এবং মুজিববর্ষের শেষ ভাগে ডিসেম্বর মাসে আরও ৬০টি মডেল মসজিদ উদ্বোধন করা হবে।
প্রকল্পের মোট কাজের ৩২ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে বলে জানিয়ে নজিবর রহমান বলেন, আগামী দুই বছরের মধ্যে ৫৬০টি মডেল মসজিদের সবগুলো সম্পন্ন হবে।
মডেল মসজিদে নামাজ পড়ার পাশাপাশি জ্ঞানচর্চার সুযোগ-সুবিধার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বলেন, এটি একটি কমপ্লিট মসজিদ এবং পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও আছে কি না আমরা জানি না। একইসঙ্গে ৫৬০টি মডেল মসজিদ নির্মিত হচ্ছে একটি দেশে। এটি একটি অনন্য এবং যুগান্তকারী ঘটনা আমরা বলবো।
২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে উন্নত মসজিদ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে নিজস্ব অর্থায়নে ৮ হাজার ৭২২ কোটি টাকা ব্যয়ে মডেল মসজিদ ও সংস্কৃতি কেন্দ্রগুলো নির্মাণ করছে সরকার।
৪০ শতাংশ জায়গার উপর তিন ক্যাটাগরিতে মসজিদগুলো নির্মিত হচ্ছে। জেলা পর্যায়ে ৪ তলা, উপজেলার জন্য ৩ তলা এবং উপকূলীয় এলাকায় ৪ তলা মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সংস্কৃতি কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।
এ-ক্যাটাগরিতে ৬৪টি জেলা শহরে এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় ৬৯টি চারতলা বিশিষ্ট মডেল মসজিদ নির্মিত হচ্ছে। এই মসজিদগুলোর প্রতি ফ্লোরের আয়তন ২ হাজার ৩৬০ দশমিক ০৯ বর্গমিটার।
বি-ক্যাটাগরিতে উপজেলা পর্যায়ে ৪৭৫টি মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। এগুলোর প্রতি ফ্লোরের আয়তন ১ হাজার ৬৮০ দশমিক ১৪ বর্গমিটার।
সি-ক্যাটাগরিতে উপকূলীয় এলাকায় ১৬টি মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। এগুলোর প্রতি ফ্লোরের আয়তন ২ হাজার ৫২ দশমিক ১২ বর্গমিটার। উপকূলীয় এলাকার মসজিদগুলোতে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে নীচ তলা ফাঁকা থাকবে।
একেকটি মসজিদ নির্মাণ করতে ব্যয় হচ্ছে জেলা শহর ও সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৫ কোটি ৬১ লাখ ৮১ হাজার টাকা; উপজেলা পর্যায়ে ১৩ কোটি ৪১ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং উপকূলীয় এলাকায় ১৩ কোটি ৬০ লাখ ৮২ হাজার টাকা।
জেলা সদর ও সিটি করপোরেশন এলাকায় নির্মাণাধীন মসজিদগুলোতে একসঙ্গে ১২ শ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। অপরপক্ষে উপজেলা ও উপকূলীয় এলাকার মডেল মসজিদগুলোতে একসঙ্গে ৯ শ মুসল্লির নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা থাকবে।
মডেল মসজিদ হবে গবেষণা, ইসলামি সংস্কৃতি ও জ্ঞান চর্চা কেন্দ্র
আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত সুবিশাল এসব মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সে নারী ও পুরুষদের পৃথক ওজু ও নামাজ আদায়ের সুবিধা, লাইব্রেরী, গবেষণা কেন্দ্র, ইসলামিক বই বিক্রয় কেন্দ্র, পবিত্র কুরআন হেফজ বিভাগ, শিশু শিক্ষা, অতিথিশালা, বিদেশি পর্যটকদের আবাসন, মৃতদেহ গোসলের ব্যবস্থা, হজ্জযাত্রীদের নিবন্ধন ও প্রশিক্ষণ, ইমামদের প্রশিক্ষণ, অটিজম কেন্দ্র, গণশিক্ষা কেন্দ্র, ইসলামী সংস্কৃতি কেন্দ্র থাকবে। এছাড়া ইমাম-মুয়াজ্জিনের আবাসনসহ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য অফিসের ব্যবস্থা এবং গাড়ি পার্কিং সুবিধা রাখা হয়েছে।
মডেল মসজিদগুলোতে দ্বীনি দাওয়া কার্যক্রম ও ইসলামী সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি মাদক, সন্ত্রাস, যৌতুক, নারীর প্রতি সহিংসতাসহ বিভিন্ন সামাজিক ব্যাধি রোধে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।
প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. নজিবর রহমান বলেন, মডেল মসজিদগুলো শুধু নামাজ পড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এখানে ইসলামী সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি জ্ঞান অর্জন ও গবেষণা সুযোগ থাকবে, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে।
৫৬০টি মডেল মসজিদে সারাদেশে প্রতিদিন ৪ লাখ ৯৪ হাজার ২০০ জন পুরুষ ও ৩১ হাজার ৪০০ জন নারী একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবেন।
লাইব্রেরী সুবিধার আওতায় প্রতিদিন ৩৪ হাজার পাঠক এক সঙ্গে কোরআন ও ইসলামিক বই পড়তে পারবেন। ইসলামিক বিষয়ে গবেষণার সুযোগ থাকবে ৬ হাজার ৮০০ জনের। ৫৬ হাজার মুসল্লি সব সময় দোয়া, মোনাজাতসহ তসবিহ পড়তে পারবেন।
মসজিদগুলো থেকে প্রতি বছর ১৪ হাজার হাফেজ তৈরির ব্যবস্থা থাকবে। আরও থাকবে ইসলামিক নানা বিষয়সহ প্রতিবছর ১ লাখ ৬৮ হাজার শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা। ২ হাজার ২৪০ জন দেশি-বিদেশি অতিথির আবাসন ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হবে প্রকল্পের আওতায়। কেন্দ্রগুলোতে পবিত্র হজ পালনের জন্য ডিজিটাল নিবন্ধনের ব্যবস্থা থাকবে।
রংপুরের গঙ্গাছড়া নিউ স্টার পাড়া জামে মসজিদের খতিব হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, মসজিদ শুধু নামাজ পড়ার জন্য নয়। ইসলাম ধর্মকে মসজিদে বন্দি না রেখে এর সুমহান আদর্শ সমাজে ছড়িয়ে দিতে হবে।
তিনি বলেন, মানুষ যখন ইসলামের সঠিক জ্ঞান পাবে তখন কেউ আর মাদক, সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের সঙ্গে জড়িত হবে না। যৌতুক-নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হবে, মানুষ অন্যায় থেকে দূরে থাকবে। এক্ষেত্রে মডেল মসজিদগুলোর সঠিক ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আসাদুজ্জামান বলেন, মডেল মসজিদ নির্মাণ করায় আমরা খুশি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য দোয়া করি তিনি যেন ধর্মীয় কাজগুলো বেশি বেশি করতে পারেন।
নীলফামারী সদরের বায়তুল আমান জামে মসজিদের খতিব মাওলানা মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, মসজিদ হচ্ছে সামাজিক মিডিয়া। সামাজিক অবক্ষয় ও অন্যায়-কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করতে মসজিদগুলো সবচেয়ে বেশি অবদান রাখতে পারে।
মডেল মসজিদ নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ এবং তার দীর্ঘায়ু কামনা করেন মাওলানা মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০২১
এমইউএম/এমএইচএম