ঢাকা: পুরুষের পাশাপাশি ৬৮ বছর বয়সী বৃদ্ধা সাফিয়া গাবতলী মিরপুর বালুঘাটে ২৫-৩০ কেজি ওজনের পাথর, বালু, বা কয়লার টুকরি টেনে যাচ্ছেন বিগত ৩০ থেকে ৩৫ বছর ধরে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ কাজ করেন তিনি।
৬৮ বছর বয়সে মানুষ সাধারণত অন্যের সহযোগিতায় বেঁচে থাকার চেষ্টা করে, আর আপনি তার কোনোটাই না করে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করছেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে সুফিয়া বাংলানিউজকে বলেন, ‘অন্যের কাছে চাইতে বা ভিক্ষা করতে লজ্জা লাগে। নিজেই করে খাই। আল্লাহ আমাকে পৃথিবীতে পাঠানোর পর থেকেই যেন আমার জীবন যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে আছে। ’
তিনি বলেন, ‘একাত্তরের যুদ্ধ দেখেছি, আমার জীবনের যুদ্ধও যেন শেষ হচ্ছে না। আমার বাবা অনেক গরিব ছিলেন। আমরা এক ভাই ও এক বোন ছিলাম, তারপরও অভাবের তাড়নায় স্কুলে যেতে পারিনি। বাবা ঠিকমতো খাওয়াতেও পারতেন না। ১৩ বছর বয়সে আমার বিয়ে দিয়ে দিলেন। এর দুই বছর পর আমার একটি মেয়ে হলো। মেয়েটা যখন বসতে শিখলো, তখন মেয়ের বাবা আমাকে ফেলে রেখে চলে যায়। ’
‘তারপর আমার বেঁচে থাকার নতুন সংগ্রাম শুরু হয়। দুধের শিশুকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় ও অন্যের ক্ষেতে খামারে কাজ করতে শুরু করি। মাঝেমধ্যে মেয়েটিকে অন্যের বাসায় রেখে আসতাম। এভাবে মেয়েকে মানুষ করার চেষ্টা করি এবং কিছুদিন স্কুলেও পড়াই। মেয়ের বয়স যখন ১৪/১৫ বছর, তখন পাশের গ্রামে এক কৃষকছেলের সঙ্গে তার বিয়ে দেই। তারও অভাবের সংসার। এদিকে ভাইটাও বাড়ির সামান্য ভিটাটুকু বিক্রি করে কোথাও চলে গেছে, তার কোনো খবর আমি আজও জানি না। ’
‘৮৮ সালের বন্যার পর মানিকগঞ্জ হরিরামপুর ছেড়ে চলে আসি গাবতলী বালুরঘাটে। সেই থেকে এই ঘাটে ইট, বালু, কয়লা ও পাথর টানার কাজ করেই যাচ্ছি। ’
প্রতিদিন কত টাকা আয় হয়, এ প্রশ্নের জবাবে সাফিয়া বলেন, ‘জাহাজ থেকে ট্রাকে সাত টুকরি দিলে ২০ টাকা পাই। কোনোদিন ৫০ টাকা, কোনোদিন ১০০-২০০ টাকা। যেদিন শরীর চলে না, সেদিন ওই গাছতলায় শুয়ে থাকি। আমিনবাজার বরদেশী এলাকায় বাসাভাড়া করে থাকি। ঘরভাড়া ১২শ’ টাকা। থাকা-খাওয়া বাদ দিয়ে যা থাকে, সব আমার নাতি-নাতনির পেছনে খরচ করি। ’
তিনি অভিমানী কণ্ঠে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গরিব মানুষকে ঘর দিচ্ছে, কিন্তু আমাকে তো কিছুই দিলো না। চেয়ারম্যান-মেম্বারের কাছে অনেকবার বলেছি, তারাও কিছু দেয় না। বলে ঘর নিতে গেলে এক লাখ টাকা লাগবে, জমি লাগবে, দলিল লাগবে। কই পাবো জমি, কে দেবে এক লাখ টাকা? আল্লাহ ছাড়া কেউ আমারে দেখলো না!’
‘আমার মেয়েটার ছেলে ও মেয়ে দুই জনই ইঞ্জিনিয়ার হতে যাচ্ছে। আর তিন-চার বছর যদি আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখে, তবে দুই জনকেই ইঞ্জিনিয়ার হতে দেখতে পারবো। তাহলে একটু হলেও মনে শান্তি পাবো। আমার নাতিরা সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। আমার মতো অসহায় মানুষের পাশে ওরা দাঁড়াবে এবং সাহায্য ও সহযোগিতা করবে এটাই আমার কামনা। ’
সাফিয়া বেগমের নাতি (মেয়ের ছেলে) মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করেছি, ফরিদপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে। এখন বিএসসি করছি ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্সে (আইইবি) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং। আর আমার একমাত্র ছোট বোন রোমানা আক্তার পড়াশোনা করছে ফরিদপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। ’
তিনি বলেন, ‘আমার বাবা একজন ক্ষুদ্র কৃষক, মা গৃহিণী। তারা আমাদের জন্য দিনরাত যে পরিশ্রম করেন, সেটা বলার ভাষা আমার জানা নাই! তবে আমার নানু আমার আম্মু ও আমাদের জন্য যা কিছু করেছেন এবং যা করছেন, তা বর্ণনাতীত। প্রায় ৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধা হয়ে এখনো জাহাজ থেকে পাথরবোঝাই টুকরি মাথায় করে ঝুঁকি নিয়ে তা ট্রাকে তোলেন। ’
‘আমি অনেকবার বলেছি, নানু তুমি এখন আর কাজ করো না, কিন্তু তানি কারো কথা শোনেন না। তিনি বারবার বলেন, তোরা দুই ভাইবোন যেদিন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে আসবি, তারপর থেকে আমি আর কোনো কাজ করবো না। ’
নানু এত কষ্ট করে তোমাদের লেখাপড়া করাচ্ছেন, সেটি বন্ধুরা জানতে পারলে কি তোমাদের খারাপ লাগবে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা নিয়ে তো আমরা গর্ববোধ করি। আমার নানু চুরি করছেন না, ভিক্ষা করছেন না, তিনি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করে যাচ্ছেন। এতে লজ্জার কিছু নেই। ’
তিনি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘সরকারের কাছ থেকে যদি একটু সহযোগিতা পেতাম, তাহলে আরো ভালোভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারতাম। ’
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০২১
জিএমএম/এফএম