বরিশাল: প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বইপড়া আর নিয়মিত লেখার কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন বইপ্রেমী ষাটোর্ধ্ব আনিসুর রহমান স্বপন। তার পাঠাভ্যাসের কারণে ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় এখন দেশি-বিদেশি লেখকদের প্রায় ২০ হাজার বই অবস্থান করে নিয়েছে।
সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিশাল ওই বইয়ের ভাণ্ডার সংরক্ষণ করতে বরিশাল নগরের সদররোডস্থ নিজের পৈত্রিক ভিটে এবং কাউনিয়া প্রধান সড়কের শ্বশুরালয়ে আলাদা দুইটি সংগ্রহশালাও গড়ে তুলেছেন তিনি। যে কাজে তার স্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত প্রভাষক বেগম ফয়জুন নাহার শেলী সবচেয়ে বেশি সহায়তা করছেন। আর এই ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা বা লাইব্রেরি শুধু জেষ্ঠ্য সাংবদিক আনিসুর রহমান স্বপনকেই আলোকিত করেননি। এখান থেকে বিনামূল্যে বই নিয়ে পড়ে জ্ঞান-অর্জনের সুযোগ পাচ্ছেন অন্যরাও।
আনিসুর রহমান স্বপনের মতো ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংগ্রহ করা গ্রন্থ নিয়ে বরিশাল নগরের কাউনিয়া মনসাবাড়ি লেনের নিজ বাড়ির নিচতলায় ২০১৮ সালে ২২শ স্কয়ার ফিটের লাইব্রেরি গড়েছেন বানারীপাড়া ডিগ্রি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক (অবসরপ্রাপ্ত) সহকারী অধ্যাপক নজরুল হক নীলু। বইপড়ুয়া ওই মানুষটি এখন বরিশল জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। তার স্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা মাহামুদা বেগম মুনমুনের সহায়তায় গড়ে ওঠা এই লাইব্রেরিতে কয়েক হাজার বইয়ের সম্ভারের মধ্যে রয়েছে দীর্ঘ ৫০ বছরের পুরোনো গ্রন্থও।
বয়োজ্যেষ্ঠ ওই দুই বইপ্রেমীর মতো নগরের ভাটিখানা বাজার এলাকায় নিজের পিত্রালয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে সাড়ে তিন হাজার বইয়ের লাইব্রেরি গড়েছেন এই প্রজন্মের নারী বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. সৈয়দা নাসরিন। যিনি নিজে প্রচুর যেমন বই পড়েন তেমনি বই লেখালেখির কাজটিও করেন। লাইব্রেরি গড়ার এ উদ্যোগকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে সব থেকে বেশি সহায়তা করেছেন তার মা বরিশাল সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কহিনুর বেগম।
এছাড়া গত কয়েক বছরে বরিশালে আরও বেশ কিছু ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে লাইব্রেরি কিংবা সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছেন। এর বেশিরভাগই নিজ বাড়িতে অবস্থিত। প্রতিটি লাইব্রেরিতে ইতিহাস, দর্শন, উপনাস্য, কবিতার গ্রন্থের অবস্থানটাই বেশি। আর লাইব্রেরির পেছনের কারিগররা প্রত্যেককে ছোটবেলা থেকে নিয়মিত বই পড়তেন এবং কিনতেন ও স্ব-যত্নে সংগ্রহ করে রাখতেন। আর এসব বইপড়ুয়া মানুষগুলো জেষ্ঠ্যদের অনুসরণ করে পাঠাভ্যাস গড়েছেন। যা তাদের পরের প্রজন্মের মাঝেও ছড়িয়ে গেছে এবং সবাই নিজ অজ্ঞনে সফলতার ক্ষেত্রে আত্মতৃপ্ত হয়েছেন। সেই তৃপ্তি থেকেই জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে সংগ্রহে থাকা বই বা গ্রন্থ দিয়ে লাইব্রেরিগুলো গড়ে তুলছেন।
নিজের সংগ্রহে বই রাখা, সেই বইয়ের সংগ্রহ বাড়ানো এবং বইগুলো পড়া নেশার মতো বলে মনে করেন লেখক আনিসুর রহমান স্বপন। তিনি বলেন, বাবা প্রয়াত আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইসমাইল খানকে দেখে ছোটবেলা থেকেই বইপড়ার আগ্রহ জন্মায়। মাত্র ৪/৫ বছর বয়সে পড়ে গিয়ে ডান চোখটি দৃষ্টিক্ষমতা হারিয়ে ফেলি। এরপর থেকে একচোখ সঙ্গী। এমনও দিন গেছে চোখের ডাক্তার দেখানোর জন্য আব্বা টাকা দিয়েছেন, তা দিয়ে ডাক্তার না দেখিয়ে নতুন বই কিনে আনতাম। আবার সদররোডের বাসার নিচতলার দোকানের ভাড়া অনেক মাসেই আব্বা নিতে পারতেন না। কারণ বই কিনে কিনে ভাড়ার টাকা খুইয়ে দিতাম। তারপরও বই পড়া কখনো ছাড়িনি। মাত্র একটি চোখের ওপর চাপ দিয়ে বইপড়া চালিয়ে গেছি। এখনও এমন হয় বই পড়তে পড়তে রাত-ভোর হয়ে যায়।
তার মতে, বেশি বেশি বই পড়লে যেমন বেশি বেশি জ্ঞান-অর্জন হয়, তেমনি সামাজিক- পারিপার্শ্বিক সমস্যা থেকে দূরে থাকা যায়। আর একতরফা বই না পড়ে সব ধরনের বই পড়লে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধ হওয়া থেকে দূরে থাকা যায়। আর নিজের জাতি, ধর্ম, সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে হলে অবশ্যই বেশি বেশি বই পড়তে হবে। আর এভাবে পাঠাভ্যাসও গড়ে উঠবে। এর ওপর লেখকের লেখার মান নির্ভর করে।
ওই বইপ্রেমী বলেন, তার লাইব্রেরি শুধু তাকেই আলোকিত করেনি, বরিশালের বইপ্রেমীদেরও আলোকিত করতে সহায়তা করছে। এ ধরনের ব্যক্তিগত লাইব্রেরির উদ্যোগ আরও হলে নতুন প্রজন্মের জন্য জ্ঞান-অর্জনের পথ সুগম হবে।
নিজেকে বিদগ্ধ পাঠক মনে করেন বলে জানিয়ে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নজরুল হক নীলু বলেন, ক্লাস সেভেনে থাকতে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অন্য বই পড়ার অভ্যাস শুরু করি এবং তখন থেকেই ২/১টা বইও কিনতে শুরু করি। তখনই ডা. নীহাররঞ্জন গুপ্তের উপন্যাস পড়েছি।
তিনি বলেন, খাওয়া রেখে বইপড়ার জন্য মায়ের মন্দ কথাও শুনতে হয়েছে আমাকে। আবার এমন হয়েছে যে একাডেমিক পড়াশোনায় মন বসছে না, তখন পাঠাভ্যাসে মনোনিবেশ ঘটাতে উপন্যাস ও গল্পের বই পড়তাম। আর এগুলো জ্ঞান বাড়িয়েছে। আমার মনে হয় মানুষের সত্ত্ব’র কাছে পৌঁছাতে হলে জ্ঞানের বিকল্প নেই। আর জ্ঞানের মাধ্যম বই। একটি মুদ্রিত বই পড়তে গিয়ে ঘটনা বা ইতিহাসের ভেতরে যেমন নিজেকে নিয়ে যাওয়া যায়, অন্য কোনো মাধ্যমে তা সম্ভব নয়। যেমন দেবদাসের বই পড়ে যত মানুষকে কাঁদতে শুনেছি, হলের ছবিতে তত মানুষ কাঁদেনি।
তিনি বলেন, লাইব্রেরিটি গড়ার জন্য সব থেকে বেশি সহায়তা করেছে আমার স্ত্রী। তিনি আমার থেকেও সৎ মানুষ। লাইব্রেরির ভবন তৈরির অর্থের যোগান, বই গোছানোর কাজে তার অবদান রয়েছে। আর বইগুলোর বেশিরভাগই আমার টাকায় কেনা। লাইব্রেরিটি বইপ্রেমীদের জন্য উম্মুক্ত। ইচ্ছে আছে পাবলিক লাইব্রেরি হিসেবে এটিকে ট্রাস্টের আওতায় নিয়ে আসার। তবে, আফসোস যত বই এখানে আছে, মরে যাবো কিন্তু সবগুলো পড়া হবে না। তবে ব্যক্তি উদ্যোগে আরও লাইব্রেরি গড়ে উঠুক সে প্রত্যাশাও থাকবে। ট্রাস্টের আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে আইনজীবী ড. সৈয়দা নাসরিনের ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়া লাইব্রেরিটি। তার মা কহিনুর বেগম বলেন, ড. সৈয়দা নাসরিন সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে এই লাইব্রেরিটি করেছে। যেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে লেখা বইয়ের আলাদা এবং শিশুদের ছড়া-কবিতার বইয়ের আলাদা গ্যালারি রয়েছে।
তিনি বলেন, পাঠাভ্যাসের কারণে অর্জিত জ্ঞান নিজের অবস্থানকে দৃঢ় করে। লাইব্রেরিতে যত মানুষের পদচারণা ঘটবে ততই এটি সমৃদ্ধশালী হবে। আমরা চাই এ অঞ্চলের শিক্ষার্থী ও বইপ্রেমীদের লাইব্রেরিটি কাজে আসুক।
ড. সৈয়দা নাসরিনের ভাই সৈয়দ আশরাফ কলিন্স বলেন, বাবাকে দেখে দেখেই ছোটবেলা থেকেই তাদের দুই ভাই-বোনের বই পড়ার অভ্যাস ছিলো। আর সেখান থেকেই বই সংগ্রহ করা। মার্কেটিং জন্য দেওয়া টাকা দিয়ে বই কিনেছেন আর খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে সেগুলো পড়েছেন। এখন হয়তো একাডেমিক চাপের অন্য বই পড়ার সুযোগ কম। আবার মোবাইলের যুগে পৃষ্ঠা খুঁজে খুঁজে বই পড়াটাও কঠিন, তবে, মুদ্রিত বইয়ের গন্ধ একটা আলাদাভাব তৈরি করে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০২১
এমএস/এএটি