ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

থামানো যাচ্ছে না সোনা চোরাচালান

ঘুরেফিরেই আসছে ইউএস বাংলার নাম

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২১
ঘুরেফিরেই আসছে ইউএস বাংলার নাম

কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না সোনা চোরাচালান। অতীতে অন্য অনেক এয়ারলাইনসের নাম এলেও কয়েক বছর ধরেই ঘুরে ফিরে আসছে ইউএস-বাংলার নাম।

শুধু যাত্রী নয়, স্বর্ণের বারসহ ধরা পড়ছেন এই এয়ারলাইনসে কর্মরত এয়ার হোস্টেজ, কাস্টমার সার্ভিস অফিসার, এমনকি ক্যাটারিং সার্ভিসের কর্মীরা। তাঁরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিচ্ছেন। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, আড়ালেই থেকে যাচ্ছে চোরাচালানে জড়িত গডফাদাররা। এ নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন অনেক অপরাধ বিশেষজ্ঞ। তাঁরা বলছেন, কর্তৃপক্ষের উচিত হবে এসব মামলার তদন্তে গভীরে গিয়ে মূল গডফাদারদের শনাক্ত করা। এরপর তাঁদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। না হলে, এভিয়েশন সেক্টরে দেশকেই এর জন্য মূল্য দিতে হবে। দেশের স্বার্থেই বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহার করতে দেওয়া ঠিক নয়।

গত মঙ্গলবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুবাই থেকে আসা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট থেকে সাত কেজি সোনা উদ্ধার করেছে কাস্টসম গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এ সময় সন্দেহভাজন হিসেবে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ক্যাটারিং সার্ভিসের আট কর্মীকে আটক করা হয়। পরে রাজস্ব কর্মকর্তা রেশমা খাতুন বাদী হয়ে মামলা দায়েরের পর গতকাল বুধবারই আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের নির্দেশে চার দিনের রিমান্ডে নেয় বিমানবন্দর থানা পুলিশ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক কবির হোসেন গ্রেপ্তারকৃতদের প্রত্যেকের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, ‘বিমানবন্দরে কিংবা এয়ারলাইনসগুলোর কোথায় কোথায় সমস্যা আছে এগুলো তো সবাই কমবেশি জানে। কই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে তো এমন ঘটনা খুব একটা ঘটছে না। তাহলে ঘটছে না কেন? কর্তৃপক্ষ শক্ত না হলে এগুলো ঘটতেই থাকবে। ’

আরেক এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ নূরুল হক বলেন, ‘যত দূর জানি সোনার মাধ্যমে পেমেন্ট করা হয়। তা হতে পারে অস্ত্র কিংবা মাদক। তবে এসব কর্মকাণ্ড বন্ধ করার জন্য পেছনের ইন্টারেস্টেড পার্টিকে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ’

মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার সকাল ৭টায় ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের দুবাই থেকে আসা বিএস৩৪২ ফ্লাইট বিমানবন্দরের ৪ নম্বর বোর্ডিং ব্রিজে অবতরণ করে। ওই বিমানের উচ্ছিষ্ট খাবারের বক্স ক্যাটারিং সার্ভিসের গাড়িতে তোলা হয়। এ সময় গাড়ি তল্লাশি করে সোনাগুলো পাওয়া যায়। আটক ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ক্যাটারিং সার্ভিসের আট কর্মী হলেন—ক্যাটারিং সহকারী মো. আলী রেজা, সাদ্দাম হোসেন, রাশেদুল ইসলাম, আব্দুর রাজ্জাক, আবু সালেহ, হানিফ দেওয়ান, জাহেদুর রহমান ও ক্যাটারিং হেলপার আশরাফুল আলম। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে সাতজন ক্যাটারিং সহকারী এবং একজন ক্যাটারিং হেলপার রয়েছেন। হাই লিফট কাভার্ড ভ্যানের ফুড স্টোরেজ গাড়িতে বিশেষভাবে সোনাগুলো লুকানো ছিল। আটকরা সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত বলে ধারণা করছে কাস্টমস গোয়েন্দা। কাস্টমস গোয়েন্দারা বলছেন, মঙ্গলবার সাত কেজি ওজনের ৬০ পিস সোনার বার পাওয়া যায়। যার আনুমানিক মূল্য চার কোটি ৮৭ লাখ ২০ হাজার টাকা।

কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. ইফতেখার আলম ভুঁইয়া জানান, এ ঘটনায় ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ক্যাটারিং সার্ভিসের আট কর্মীকে আটকের পাশাপাশি সেই গাড়িটি জব্দ করে বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা করা হয়েছে।

এর আগে, গত ২২ জানুয়ারি মাসকাট থেকে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে আসা সারোয়ার উদ্দিন নামে এক যাত্রীর কাছ থেকে সাত কেজি ২৯০ গ্রাম সোনা উদ্ধার করে ঢাকা কাস্টম হাউস। এর আনুমানিক মূল্য প্রায় পাঁচ কোটি  টাকা। বিমানবন্দর থানায় মামলা হলেও বর্তমানে এর তদন্ত করছেন কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের পরিদর্শক মোরশেদ। গ্রেপ্তারের পরপরই সারোয়ার উদ্দীন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

কাস্টমস সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে দুই কোটি ৩২ লাখ টাকার চার কেজি ৬৪০ গ্রাম সোনা উদ্ধার করে ঢাকা কাস্টম হাউস। সোনার বারগুলো কালো স্কচটেপ মোড়ানো অবস্থায় ছিল। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ফ্লাইট নম্বর বিএস৩১৬-এর যাত্রী অবতরণের সিঁড়ির নিচে ৪০টি সোনার বার পাওয়া যায়। একই বছরের ৩১ জুলাই একই বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলার যাত্রী বহনকারী গাড়ির চালকের কাছ থেকে তিন কেজি ৭১২ গ্রাম সোনা উদ্ধার করে কাস্টমস, যার মূল্য প্রায় তিন কোটি টাকা।

২০১৯ সালের ২২ নভেম্বর শাহজালালে তিনটি সোনার বারসহ ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের কাস্টমার সার্ভিস অ্যাসিস্ট্যান্ট ওমর ফারুককে আটক করে ঢাকা কাস্টম হাউস। বিদেশ থেকে সোনার বারগুলো নিয়ে আসা মামুন মিয়া নামে এক যাত্রীকেও আটক করা হয়। এর আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ১৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা। কাস্টম হাউসের প্রিভেনটিভ টিম বিমানবন্দরের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে ট্রানজিট ও বোর্ডিং এলাকায় নজরদারি এবং তল্লাশি করে। আটক যাত্রী ও ইউএস-বাংলার কর্মীকে পুলিশে দেওয়া হয়।

একই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে সোনা চোরাচালানে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ১০ কেজি সোনার বারসহ ৫ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের কেবিন ক্রু রোকেয়া শেখ মৌসুমী। এ ঘটনায় এপিবিএনের এসআই হেলাল উদ্দিন বাদী হয়ে মৌসুমীসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন।

২০১৯ সালের ২০ এপ্রিল ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ফ্লাইট থেকে প্রায় সাত কোটি টাকা মূল্যের ১৪ কেজি সোনা জব্দ করে শুল্ক গোয়েন্দা। ২০১৭ সালের ১১ অক্টোবর শাহজালাল বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট থেকে চার কেজি ৬৪ গ্রাম সমান সোনার বার উদ্ধার করে ঢাকা কাস্টম হাউস। একই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর শাহজালাল বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ফ্লাইট থেকে চার কেজি ৬৬৫ গ্রাম সমান সোনার বার উদ্ধার করে শুল্ক গোয়েন্দা। এয়ারলাইনসের (ফ্লাইট নম্বর বিএস২০২) থেকে ওই সোনা উদ্ধার করা হয়। এর বাজারমূল্য প্রায় দুই কোটি ৩০ লাখ টাকা।

পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, সোনা চোরাচালানের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় যথাযথ নিয়ম অনুসারেই তদন্ত করা হয়। সবগুলো মামলাই যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়।

গতকাল সন্ধ্যায় ইউএস-বাংলায় সোনা চোরাচালানের ঘটনা প্রসঙ্গে ফোন দেওয়া হয় ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদকে। তিনি জানান, এখন তিনি আর নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করেন না। কাস্টমার সার্ভিস দেখছেন। তিনি এ বিষয়ে জনসংযোগ বিভাগে কথা বলতে বলেন। পরে জনসংযোগ বিভাগের প্রধান কামরুল ইসলামকে কয়েকবার কল করা হয়। প্রতিবারই তিনি লাইন কেটে দেন।

সৌজন্য: কালের কণ্ঠ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।