বরিশাল: ই-মেইলে কিংবা ম্যাসেঞ্জারের বার্তা আদান-প্রদানের এ যুগে এসে হাতে লেখা চিঠির প্রচলন একেবারে নেই বললেই চলে। অনেকে যেমন না লিখতে লিখতে ভুলে গেছেন চিঠি লেখার কথা আবার নতুন প্রজন্ম তো এ বিষয়ে ওয়াকিবহালই নন।
প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় হারিয়ে যাওয়া যোগাযোগের সেই অন্যতম মাধ্যম ‘চিঠি’ লেখাকে ফিরিয়ে আনতে গত কয়েকবছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ‘ঐতিহ্য রক্ষায় আমরা (ঐরা)’ নামের একটি সংগঠন। সংগঠনটির অন্যতম উদ্যোক্তা বরিশাল নগরের বাংলাবাজার এলাকার ছেলে রাফি হাসান অনিকের হাত ধরে ২০১৬ সালে প্রথম ঢাকায় এই চিঠি লেখা উৎসবের আয়োজন করা হয়।
সেই অনিক বাংলানিউজকে বলেন, বরিশালের রাস্তায় হাটতে হাটতে একটি চিঠি কুড়িয়ে পাই। যে চিঠিটি দেখেই মনে হয়েছে বহু পুরাতন আর চিঠির লেখায় আগেবগটা অন্যরকম ছিলো। তখন আমার মাথায় আসে, বাবা দেলোয়ার হোসেন এয়ারফোর্সে চাকরি করতেন, আমি খুব ছোট ছিলাম তখন বাবার সঙ্গে মা টেলিফোন আর চিঠিতে যোগাযোগ রাখতেন। সেসময় বাবার কাছে আমিও ছোট ছোট ভাঙা ভাঙা অক্ষরে চিঠি লিখতাম। অর্থাৎ পত্রমিতালীর মতো বিষয় তখন ছিলো। এরপর সেই কুড়িয়ে পাওয়া চিঠি দেখেই সখের বসে ধীরে ধীরে মাথায় চিঠি লেখার চিন্তা আসে। যে চিন্তা থেকে বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করে চিঠি লেখা উৎসবের আয়োজনের শুরু। ২০১৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে প্রথমবারে ঢাকার টিএসসিতে এ আয়োজনটি করা হয়। যে আয়োজনের শেষে সেরা ১০ চিঠির লেখককে পুরস্কৃতও করা হয়।
ওই আয়োজনেই প্রথমবারের মতো কাগজের ঠোঙা দিয়ে লেটারবক্স তৈরি করি। যে বক্সগুলোতেই মূলত চিঠিগুলো ফেলেছেন লেখকরা। তিনি বলেন, চিঠির জন্য বক্সের হিসেবটা মূলত আসে বিভিন্ন বাসা বাড়িতে থাকা লেটারবক্স থেকে। যেখানে বর্তমানে অ্যাপয়নমেন্ট ছাড়া ব্যক্তিগত কোন চিঠিই আসে না। কিন্তু একসময় এ লেটারবক্সই ছিলো চিঠি পাঠানোর অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম।
অনিক বলেন, শুরুর বছর আমরা ৩০টির মতো চিঠি পাই, এরপরের বছর আমরা আয়োজনটি করতে পারেনি, তবে ২০১৮ সালে টিএসসিতে এবং ২০১৯ সালে ধানমন্ডিতে আবারও এ আয়োজনটি করি।
ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে শুরু করা চিঠি লেখার এ আয়োজনে নানা ধরনের চিঠি আমরা পেতে শুরু করি। যেখানে শুধু প্রেমিক-প্রেমিকাই নয়, বাবা-মা তার সন্তান, সন্তান তার বাবা-মাকে, ভাই তার বোনকে কিংবা বোন তার ভাইকেও চিঠি লিখছে। একবার একটি ছোট বাচ্চার চিঠি পেয়েছিলাম, যে বাচ্চাটি শুধু অ-আ লিখে দিয়েছেন চিঠিতি।
তিনি বলেন, মূলত এ আয়োজনটি ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে করা তাই প্রতিবারের আয়োজন ১৪ জানুয়ারি থেকে শুরু করে ১৪ ফেব্রুয়ারিতে শেষ করা হয়। তবে বিগত দিন পর্যালোচনা করে দেখেছি আমাদের পাওয়া চিঠিগুলো বাংলাভাষায় লেখাছিলো, আর বাংলাভাষায় চিঠির আবেগ অনুভূতিগুলোও ছিলো অন্যরকম। এজন্য এবারের আয়োজনটা মাতৃভাষা দিবসকে ঘিরে করেছি, অর্থাৎ ভাষার মাসে ভাষা ও অক্ষরের সঙ্গে থাকার চিন্তা। তাই ২১ ফেব্রুয়ারি এবারের চিঠি লেখা প্রতিযোগিতার সমাপনি আয়োজনটি করার চিন্তাভাবনা রয়েছে আমাদের। যেখানে ভাষার মাসে ভাষা ও অক্ষরের সঙ্গে যথারীতি থাকছে সেরাদের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থাও।
তিনি বলেন, এবারের আয়োজন বড় পরিসরে দেশজুড়ে করা হবে। এবারের আয়োজনের প্রথমে জানুয়ারির ১৪ তারিখে বরিশাল নগরের ব্যপ্টিষ্ট মিশন রোডের শেষ মাথায় ডিসির লেকের দক্ষিণ প্রান্তে মিক বিশ্বাসের চায়ের দোকানে একটি চিঠির বাক্স বসিয়েছি। এছাড়া ঢাকাতেও দু’একদিনের মধ্যে চিঠির বাক্স বসানো হবে, সেইসঙ্গে যেহেতু সমগ্র দেশ থেকে হাতে লেখা চিঠি চাচ্ছি, তাই আমরা এবারে একটি নির্দিষ্ট ঠিকানাও ব্যবহার করছি। আর এর সামগ্রিক প্রচারণা ঐরার ফেইসবুক পেইজেও চালানো হচ্ছে।
এ সংগঠনের অন্যতম সংগঠক নিয়াজ মোর্শেদ বলেন, হাতে চিঠি লিখে মনের ভাব যেভাবে প্রকাশ করা যেতো তা ই-মেইল কিংবা কোন ম্যাসেঞ্জারে সম্ভব নয়। তাই হাতে লেখার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে চিঠি উৎসবের আয়োজন। এখানে যে কেউ চিঠি লিখতে পারেন। শুধু প্রেমিক-প্রেমিকা নয়, মা ছেলেকে লিখতে পারেন, আবার মেয়ে ও পারেন বাবার জন্য চিঠি লিখতে। এবারে আমাদের প্রতিপাদ্য ধর্ষনের বিরুদ্ধে উড়ো চিঠি।
বরিশালে চিঠির বাক্সটির দায়িত্বে থাকা চায়ের দোকানদার মিক বিশ্বাস জানান, নিজেদের চিন্তাভাবনা দিয়ে কাগজের চিঠির বাক্সটি সাজিয়ে বানিয়েছি। মানুষের মনেই চিঠি লেখার বিষয়টি নেই, তারপরও বিশ্বাস করি অনেক চিঠি পাবো এই বক্সের ভেতরে। চিঠির বাক্স দেখে মানুষের নানা ধরনের মন্তব্য শুনছি প্রতিনিয়ত। এরইমধ্যে বেশ কয়েকজন চিঠিও ফেলেছেন বাক্সটিতে।
এদিকে ঐরার কাগজের তৈরি চিঠির বাক্সটি নিয়েও জল্পনা-কল্পনার কোন শেষ নেই আগতদের। কারণ বিভিন্ন রং দিয়ে ফুটিয়ে তোলা এ চিঠির বাক্সের বাহিরের অংশে ‘মিকি মামার প্রেমের জ্বালায়, কাস্টমারের অবহেলায়, বিকেল হতে চাতাল মনে পড়ছে দীর্ঘশ্বাস, চায়ের তরে চাতক হতো একি পরিহাস’ এমন কিছু লেখা, কিছু ছন্দ রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৭, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২১
এমএস/এমআরএ