নাটোর: ঘড়ির কাটায় সময় তখন সকাল ৬টা। কুয়াশার চাদরে চারদিক ঢাকা।
সারিবদ্ধভাবে বসে দুধের দাম হাঁকছেন আর ক্রেতারা এসে দুধ কিনছেন। এ যেন দুধের হাট। প্রতিদিন ভোর হলেই কয়েকটি গ্রামের মানুষ তাদের বাড়িতে লালন পালন করা দেশীয় প্রজাতির গাভির দুধ বিক্রি করতে সমেবেত হন এক স্থানে। এতে দুধ বিক্রেতা আর ক্রেতাদের ভিড়ে মিলন মেলায় পরিণত হয়।
বেলা ওঠার আগেই তারা দুধ বিক্রি করে ফিরে যান বাড়িতে। এটা শুধু একদিনের জন্য নয়। গত দুই দশক ধরে চলছে এইভাবে সম্মিলিত ও সারিবদ্ধভাবে দুধ বিক্রির প্রচলন। শুধু তাই নয়, দুধ বাজারকে ঘিরে একই সময়ে কাঁচা তরিতরকারি, মাছ-মাংস, হাঁস-মুরাগিসহ বিক্রি হয় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। সরজমিনে গিয়ে নলডাঙ্গা উপজেলার পারবিশা গ্রামে গিয়ে এমন দৃশ্যই দেখা মেলে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নাটোর শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার উত্তরে নওগাঁর আত্রাই উপজেলা সংলগ্ন পুরোনা আত্রাই নদীর পাড়ে নলডাঙ্গা উপজেলার পারবিশা গ্রামে প্রতিদিন এই দুধের হাট বসে। এই হাটে বিভিন্ন এলাকা থেকে দুধ কিনতে আসেন ক্রেতারা। ক্রেতাদের বেশিরভাগই সাধারণ মানুষ।
হাতে গোনা কয়েকজন আছেন ঘোষ। তারা প্রয়োজনীয় দুধ সংগ্রহ করে বাড়িতে তৈরি করেন দুধের ছানা এবং হরেক রকম মিষ্টি। এই হাটে সকাল ৬টা থেকে শুরু হয় দুধ বিক্রি, সাতটা বাজতে বাজতে শেষ হয়ে যায় বেচা-কেনা। অর্থাৎ রোদ ওঠার আগেই হাটের কেনা বেচা শেষ।
স্থানীয় সাবেক ইউপি সদস্য গোলাম মোস্তফা (৭৫) জানান, ১৯৬৪ সালে পুরনো আত্রাই নদীর পাড়ে পারবিশা হাটটি গড়ে ওঠে। এক সময় জমজমাট হাট বসতো এখানে। যোগাযোগের কোনো রাস্তাঘাট না থাকায় নদী ও খাল দিয়ে নৌকায় করে মালামাল আনা নেওয়া হতো। ক্রেতা-বিক্রেতাদের সমাগমে হাটটি প্রসিদ্ধ লাভ করে। পরবর্তীকালে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়ন হওয়ায় এবং যত্রতত্র বাজার গড়ে ওঠায় হাটের অবস্থা ভাটা পড়ে। এখন কোনো মতে টিকে আছে হাটটি। তাও আবার দুধের ওপর নির্ভর করে।
স্থানীয়রা জানান, প্রতিদিন পারবিশা হাটে ১৫০-২০০ জন দুধ বিক্রি করেন। প্রতিদিন ১০-১২ মণ দুধ বিক্রি হয়। বাড়িতে লালন পালন করা একেবারে দেশীয় জাতের গরুর খাঁটি দুধ। সকাল ৬-৭টার মধ্যে দুধ কেনাবেচা শেষ হয়। এ নিয়ে এলাকায় বিশাল কর্মযজ্ঞ সৃষ্টি হয়েছে। এতে একদিকে স্থানীয়দের দুধের চাহিদা মিটছে, অপরদিকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন গাভি পালনকারিরা।
হাটবিলা গ্রামের ফয়েজ উদ্দিন মোল্লা (৭৫) ও সোনা মিয়া (৫৫) বাংলানিউজকে জানান, তাদের ছয়টি গাভী রয়েছে। এদের মধ্যে দুইটি গাভি দুধ দেয় প্রতিদিন ৩-৪ কেজি করে। যা নিম্মে ৪০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৬০ টাকা দরে বিক্রি করেন এই পারবিশা হাটে।
একই গ্রামের আব্দুল ওয়াদুদ (৬৫) বাংলানিউজকে জানান, তার দুই গরুর দুধ হয়। চারটি গরু আছে। প্রতিদিন ৪-৫ কেজি করে দুধ বিক্রি করেন। বাড়ির পাশে দুধের হাট হওয়ায় তারা খুব সহজেই দুধ বিক্রি করেন। এখানকার দুধের চাহিদা রয়েছে অনেক। কারণ এ এলাকার পালিত গাভিগুলো দেশীয় প্রজাতির এবং খড়, খৈল, ঘাসসহ স্বাভাবিক খাবার খায়। কোনো প্রকার ক্ষতিকারক খাবার খাওয়ানো হয় না। এজন্য দুধের গুনাগুন ভাল। একই কথা জানালেন, দুধ বিক্রেতা দুলাল (৫০), সাইদুর রহমানসহ (৪৫) আরো অনেকে।
প্রতিদিন দুধ কিনতে আসা দুর্লভপুর গ্রামের আ.ফ.ম শামসুজ্জামান সেন্টু, করের গ্রামের মেহেদী হাসান, বাকিওলমা গ্রামের সাইফুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, বারবিশা হাটে বিক্রিত দুধগুলো খাঁটি ও গুণে মানে ভালো। কোনো প্রকার ভেজাল বা পানি মেশানো থাকে না। এছাড়া অন্য এলাকার তুলনায় এখানকার দুধের দাম অনেক কম। তাই তারা প্রতিদিন এখান থেকে দুধ কিনে নিয়ে যান।
মাধনগর ইউনিয়নের ভট্টপাড়া গ্রামের সন্তোষ ঘোষ বাংলানিউজকে জানান, পারবিশা হাট থেকে কেনা দুধে ছানা ভালো হয়। তাই গুণগত মানসম্পন্ন মিষ্টিও তৈরি করা যায়। দেশীয় জাতের গরুর দুধের কারণে ছানার মান ভালো। তাই বিভিন্ন এলাকা থেকে ঘোষেরা এসে এখান থেকে দুধ কিনে নিয়ে যান। স্থানীয় ময়লাল, বিষু ঘোষ, কালু ঘোষও এখানে প্রতিদিন দুধ কিনতে আসেন। প্রায় সারাবছরই তারা এখান থেকে দুধের চাহিদা মেটান এবং ছানা প্রস্তুত করে বাজারজাত করে থাকেন।
খাজুরা ইউপির ৮ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য নুরুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, এই এলাকায় বিশেষ করে পারবিশা গ্রামে প্রতিটি বাড়ি বাড়ি দেশীয় প্রজাতির গাভী পালন করা হয়। সারাবছর দুধ বিক্রি করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন একজন মানুষ। পারবিশাসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের অর্থনৈতিক চিত্র পাল্টে গেছে। অনেকে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন এই দুধ বিক্রির ওপর।
তিনি বলেন, গত ২০ ধরে পারবিশা হাটে সকালে দুধ বিক্রি হয়। তবে ১০ বছর ধরে কেনা-বেচা আরো জমজমাট হয়। তার মতে গড়ে প্রতিদিন ১০-১২ মন দুধ আমদানি হয়। ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার টাকা মণ দরে দুধ বিক্রি হয়। সে হিসেবে গড়ে ১ হাজার ৬০০ টাকা মন দরে গড়ে ১০ মণ দুধের দাম দাঁড়ায় ১৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ১৬ হাজার টাকার দুধ বিক্রি হয় এ হাটে। আর মাসে দুধ বিক্রি হয় ৪-৫ লাখ টাকার। আর বছরে অন্তত ৫৭-৬০ লাখ টাকার দেশি গরুর দুধ বিক্রি হয় এ হাটে। তবে এখানে কাউকে কোনো প্রকার টোল বা খাজনা দিতে হয় না বলে জানান তিনি। এদিকে নলডাঙ্গা উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থ বছরে মোট দুধ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার মেট্রিক টন। সেখানে প্রতি মাসে দুধ উৎপাদন হচ্ছে ২ হাজার ১৭০ মেট্রিক টন। এ হিসেবে চলতি বছরে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৩২ হাজার ৬৪২ দশমিক ২ মেট্রিক টন দুধ পাওয়া যাবে আশা করা হচ্ছে। অর্থাৎ বছরে ৭ হাজার ৫৪২ দশমিক ২ মেট্রিক টন বেশি দুধ উৎপাদন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নলভাঙ্গা উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের ভেটেরিনারি সার্জন ডা. রকিবুল হাসান সুজন বাংলানিউজকে জানান, নলডাঙ্গা উপজেলায় রেজিস্ট্রেশনভুক্ত ১০টি গরু নিয়ে খামার রয়েছে ৩টি, ৬-৯টি গরু নিয়ে খামার রয়েছে ৮টি ও পারিবারিকভাবে পালিত খামারের সংখ্যা এক হাজার ১৩৫টি। আর বড় খামার রয়েছে ৩টি। এদের মধ্যে ভূষণগাছা গ্রামের আলোর ডেইরি ফার্মে ৫০টি গরু, বৈদ্যবেলঘড়িয়া গ্রামের জয়নাল হাজির খামারে ১৮টি গরু ও মির্জাপুর দীঘা গ্রামের আবুল কালাম আজাদের খামারে গরুর রয়েছে ১২টি।
তিনি বলেন, গরুর খামার লাভজনক হওয়ায় গরু লালন পালনে আগ্রহী হচ্ছেন অনেকেই। বিশেষ করে দেশীয় প্রজাতির গরুসহ উন্নত জাতের গরু লালন পালনে মানুষের আগ্রহ অনেক বেশি। এতে একদিকে গরু মোটাতাজাকরণ করার পর বাজারজাত করে লাভবান হচ্ছেন, অপরদিকে দুধ বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বীও হচ্ছেন তারা।
তিনি বলেন, গবাদি পশুর রোগ বালাই থেকে রক্ষা করতে প্রাণিসম্পদ দপ্তর থেকে সার্বক্ষণিকভাবে চিকিৎসা দেওয়াসহ ওষুধ সরবরাহ করা হয়ে থাকে। পাশাপাশি গবাদিপশুর লালন-পালনে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে সার্বক্ষণিক পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
নলডাঙ্গা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল্লাহ আল মামুন বাংলানিউজকে জানান, পারবিশা হাটে দুধ বিক্রি করে এ অঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষগুলো অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন এটা অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। পাশাপাশি তারা এলাকায় দুধের চাহিদাও মেটাচ্ছেন এবং অন্য এলাকার তুলনায় সাশ্রয়ী মূল্যে দুধ পাচ্ছেন এখানকার মানুষ। তাই উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গবাদি পশুর লালন-পালনে উৎসাহ দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২১
এনটি