সাভার (ঢাকা): ১৯৭৯ সালের শুরুর দিকে রাজধানীর জাতীয় চিড়িয়াখানার এক পরিচালকের বাসভবনের সহকারী মালি হিসেবে কাজ শুরু করেন ১৬ বছর বয়সী সাবেদ আলী। সেখানে সাবেদ আলীকে সব ধরনের ফুল গাছের যত্ন ও পরিচর্যা করতে হতো।
১৯৮৩ সালের শেষের দিকে সাবেদ আলী ৩৫০ টাকা দিয়ে ১০টি গোলাপের চারা কিনে তার নিজ বাড়িতে রোপণ করেন। প্রথমে তিনি চারাগুলোকে টবে রোপণ করেন। সহসাই তার ছোট্ট উদ্যোগটি বড় হয়ে গেল। ওই চারাগুলো থেকে কলমের মাধ্যমে তিনি দুই বছরের মধ্যে তার বাড়িতে গোলাপের বাগান করে ফেলেন। তার বাগানের ফুল দেখতে প্রতিদিন প্রচুর দর্শক আসতে শুরু করে। কিছু কিছু দর্শক বাগান থেকে গোলাপ কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। সেই থেকে তিনি গোলাপ বিক্রি করতে শুরু করেন। গোলাপের চাহিদা সাবেদ আলীকে বাণিজ্যিকভাবে গোলাপ চাষের স্বপ্ন দেখায়। ১৯৮৯ সালে সাভারের সাদুল্লাহপুর এলাকায় ২০ শতাংশ জমি ইজারা নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে গোলাপ চাষ শুরু করেন তিনি।
সাবেদ আলীর সন্ধানে গত শুক্রবার (১২ ফেব্রুয়ারি) সাভারের বিরুলিয়ার গোলাপ গ্রামে গেলে পাওয়া যায় তাকে। সেখানে গিয়ে দেখা যায় বৃদ্ধ বয়সে এখানো সেই আগের মতই গোলাপের ক্ষেতে বসে বসে গোলাপ গাছের চারা তৈরি করেছেন তিনি। পাশে আরও দুইজন গোলাপ চাষিকে চারার কলম করা দেখিয়ে দিচ্ছেন সাবেদ আলী। এসময় সাবেদ আলীর সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের।
সাবেদ আলী জানান, সাভারে ফুল চাষের শুরুটা খুব সহজ ছিল না তার জন্য। ফুলে বাণিজ্যিক বাজার সম্পর্কে স্থানীয়দের তেমন একটা ধারণা না থাকায় অনেকেই সাবেদ আলীকে উপহাস করতে শুরু করেন। যখন তার বাগানের প্রচুর গোলাপ ফুল ফোটে এবং সে ফুলগুলো রাজধানীর শাহবাগের পাইকারি বাজারে ভাল দামে বিক্রি শুরু করেন তখন স্থানীয়দের টনক নড়ে। পরের বছর সাবেদ আলী আরও ৩০ শতাংশ জমি ইজারা নিয়ে বাগানের পরিধি বাড়ান। সেই থেকে স্থানীয় কৃষকরা ফুল চাষে আগ্রহী হন ও চাষ শুরু করেন। সাবেদ আলী তাদের ফুল চাষ সম্পর্কে ধারণা ও সব ধরনের সহযোগিতা করতে শুরু করেন। বর্তমানে সাবেদ আলীর সঙ্গে তার সন্তানরাও তাকে সহয়তা করেন।
স্থানীয়দের কাছে জানা গেছে, সাবেদ আলী সাভারের বিশাল এলাকা যেমন সাদুল্লাপুর এবং শ্যামপুর, মোস্তাপাড়া, বিরুলিয়া, ভবানীপুর সংলগ্ন গ্রামে বড় আকারের গোলাপ চাষের পেছনে অন্যতম প্রধান শক্তি। বর্তমানে এই গ্রামগুলির প্রায় দেড় হাজার মানুষ বাণিজ্যিকভাবে গোলাপ চাষে জড়িত। গ্রামগুলি গোলাপের গ্রাম হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে।
স্থানীয় বোনগ্রাম এলাকার গোলাপ চাষি হোসেইন বাংলানিউজকে বলেন, সাবেদ ভাইয়ের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আমি প্রায় ১৫ বছর আগে গোলাপ চাষ শুরু করেছি। এখন আমি ৬০ শতাংশের একটি গোলাপ বাগানের মালিক। গোলাপ চাষের মাধ্যমে আমরা দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। সাবেদ ভাইয়ের উদ্যোগ ছাড়া এটি সম্ভব হত না।
সাবেদ আলী বাংলানিউজকে বলেন, সত্যি আমার ধারণা ছিল না যে ১৯৮৯ সালে আমার ছোট্ট উদ্যোগটি এলাকার মানুষের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত করবে। অনেক লোকই এখন আমার উদ্যোগটি গ্রহণ করছে। এটি দেখে আমি আনন্দিত। আমি সব সময়ই ফুল চাষে সবাইকে স্বাগত জানাই এবং ফুল চাষিদের আমার জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা দিয়ে সহায়তা করার চেষ্টা করি।
তিনি আরও বলেন, এতো সাফল্য সত্ত্বেও, প্লাস্টিকের ফুল আমদানির কারণে ফুলের বাজারে বেশ প্রভাব ফেলেছে। গত কয়েক বছর ধরে প্লাস্টিকের ফুল বাজার সয়লাব হয়েছে যা তাজা গোলাপের চাহিদাকে প্রভাবিত করেছে। করোনা ভাইরাসের কারণে অনুষ্ঠান কমে যাওয়ায় কৃষক ফুলের যথাযথ মূল্য পাচ্ছেন না। ফুলের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে।
গোলাপ চাষে পৃষ্ঠপোষকতা এবং কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সাবেদ আলী বলেন, গোলাপ চাষে কৃষকদের পৃষ্ঠপোষকতা ও ফুলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি সাভারে একটি পাইকারি গোলাপের বাজার, ফুল সংরক্ষণের জন্য একটি হিমাগার স্থাপন এবং ফুল রফতানির জন্য সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সাভারের প্রায় ৩০০ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ হচ্ছে। এর মধ্য সিংহভাগই গোলাপ।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২১
আরএ