সিলেট: দুই বিয়ে করেছিলেন ব্যবসায়ী আবদাল হোসেন বুলবুল। প্রথম স্ত্রী এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে থাকেন বিয়ানীবাজার গ্রামের বাড়িতে।
সৎ মায়ের সংসারকে মেনে নিতে পারেনি প্রথম স্ত্রীর ছেলে আহবাব হোসেন আবাদ (২০)। সেই ক্ষোভ থেকে তিনি নৃশংস হত্যার ঘটনা ঘটান। বাবার বঞ্চনার ক্ষোভ মেটাতে সৎ মায়ের পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে দেন আবাদ। গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কাছে হত্যাকাণ্ডের এমন স্বীকারোক্তি দেন তিনি।
তার ক্ষোভের ভয়াবহতার প্রমাণ মিলে সৎ মা রুবিয়া বেগম (৩০), তার মেয়ে মাহা (৭) ও ছেলে তাহসানের (৪) হত্যাকাণ্ডে। মা-মেয়ে ও ছেলের শরীরে শতাধিক ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন মিলে। ছুরিকাঘাত করে খন্তি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাদের হত্যা করা হয়।
সিলেট মহানগর পুলিশের শাহপরান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ আনিসুর রহমান বাংলানিউজকে এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদে আবাদ জানান, বাবার বঞ্চনার ক্ষোভে সৎ মা ও তার সন্তানদের হত্যা করেছেন।
মা-মেয়ে ও ছেলের মরদেহের সুরতহাল করতে গিয়ে ঘাবড়ে যান দুই পুলিশ কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) সারোয়ার হোসেন ও রিপটন পুরকায়স্থ। নিহতদের শরীদের ছোট-বড় অসংখ্য ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন দেখতে পান। নিহত রুবিয়া বেগমের বাম হাতের কব্জি খন্তি দিয়ে আলাদা করার চেষ্টা করা হয়। একইভাবে শিশু দু’টিকে ছুরিকাঘাত ও খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলেও ধারণা পুলিশ ও হাসপাতালের চিকিৎসকদের।
এসআই সারোয়ার হোসেন বলেন, সুরতহালে তিনজনের শরীরে অন্তত শতাধিক আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।
ওসি আনিসুর রহমান বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে আহবাব জানান, তার মাকে নিয়ে তিনি বিয়ানীবাজার গ্রামের বাড়িতে থাকতেন। সৎ মাকে নিয়ে বিআইডিসি মীর মহল্লায় থাকতেন তার বাবা। তাদের খোঁজ তেমন নিতেন না। যে কারণে ৪/৫ মাস আগে শহরে এসে বাবার সঙ্গে ব্যবসায় দেখাশোনার পাশাপাশি বাসায় অবস্থান করেন। সেই ক্ষোভ থেকে গত বৃহস্পতিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) রাতেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটান এবং সৎ মায়ের পরিবার নিশ্চিহ্ন করে দেন। খুনের ঘটনায় ব্যবহৃত খন্তি ও ছোরা উদ্ধার করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ডৌবাড়ি ইউনিয়নের হাটগ্রামের ফরমান আলীর মেয়ে রুবিয়া বেগম। প্রায় ১০ বছর আগে বিআইডিসি মীরমহল্লায় বসবাসকারী বিয়ানীবাজারের অষ্টগ্রামের আবদাল হোসেন বুলবুলের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। অথচ প্রথম স্ত্রী ও দুই সন্তান থাকার বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন বুলবুল। দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে শহরতলীর বিআইডিসি মীরমহল্লায় ভাড়া বাসায় রাখেন। প্রথম স্ত্রীর খোঁজ তেমন রাখতেন না তিনি। এরইমধ্যে অর্থাভাবে ছেলে আহবাব হোসেন পড়ালেখা বাদ দিয়েছেন। গত ৫ মাস আগে সে শহরতলীতে বাবার ব্যবসা দেখাশোনা শুরু করেন। বিভিন্ন সময় তিনি সৎ মাকে হত্যার হুমকি দিয়ে তার বাবাকে ছেড়ে যেতে বলতেন।
নিহত রুবিয়া বেগমের ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, বিভিন্ন সময় হত্যার হুমকির বিষয়টি বাড়িতে ফোনে জানান তার বোন। বলেছিলেন, ছেলেটা খুবই যন্ত্রণা দিচ্ছে। রাতের আঁধারে দরজায় এসে ডাকাডাকি করে। বিষয়টি ভগ্নিপতিকে জানান তারা। কিন্তু তিনি পাত্তা না দিয়ে বলেন, আমার ছেলেকে আমি শাসন করবো, তোমাদের কাছে কেন বিচার দেবে? ছেলেকে শাসন না করে পাল্টা যুক্তি দেখিয়েছিলেন ভগ্নিপতি। তিনি পাল্টা বলেছিলেন, আমার ছেলেকে আমি শাসন করবো, তোমরা নাক গলাবে না। তখন বলেছিলাম কোনো ঘটনা ঘটিয়ে ফেললে তখন কিছুই করার থাকবে না। ঘটলোও তাই।
সর্বশেষ চারদিন আগে তার সঙ্গে বোন রুবিয়া বেগমের কথা হয়। সেদিন তিনি বলেছিলেন, ভাগিনা-ভাগ্নিকে দেখতে আসবি না? বলেছিলেন শুক্র অথবা শনিবার আসবো। কিন্তু বোন, ভাগিনা-ভাগ্নির সঙ্গে দেখা হলো ঠিকই, তবে বাসায় নয়, হাসপাতাল মর্গে।
তিনি বলেন, আমার স্কুল পড়ুয়া ভাগ্নি (৭), চার বছরের ভাগিনা ও বোনকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যাকারী কঠিন শাস্তি স্বরূপ ফাঁসি দাবি জানাচ্ছি।
নিহতের ছোট বোনের স্বামী ফয়েজ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, চারদিন আগেও রুবিয়া আপা আমাকে ফোন করে রাতে সাবধানে চলাফেরা করতে পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন। কতো শত্রু আছে, সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা করো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি নৃশংসতার শিকার হলেন।
এদিকে শুক্রবার ঘটনাস্থল ও হাসপাতালে গিয়ে হত্যার আলামত সংগ্রহ করেছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) টিম। এছাড়া এদিন বিকেল পর্যন্ত নিহতদের মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়নি।
গত বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে সিলেট সদর উপজেলার বিআইডিসি মীরমহল্লায় ভাড়া বাসায় সৎ মা-মেয়েকে কুপিয়ে হত্যা করে আহবাব হোসেন আবাদ। গুরুতর আহত শিশু তাহসানকেও হাসপাতালে ভর্তি করা হলে শুক্রবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) ভোরে তার মৃত্যু হয়। ফলে সৎ মা রুবিয়ার পুরো পরিবার নিশ্চিন্ন করলো সৎ ছেলে রূপী ঘাতক। ঘটনার পর বাসার কলাপসিবল গেট বন্ধ থাকায় ঘাতককে আটক করতে সক্ষম হয় পুলিশ।
** সিলেটে মা-মেয়েকে কুপিয়ে হত্যা, গুরুতর আহত শিশুপুত্র
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২১
এনইউ/আরবি