সিলেট: স্বাধিকার আন্দোলনের সূতিকাগার ভাষা আন্দোলন। ভাষা শহীদদের স্মরণের স্মৃতিচিহ্ন শহীদ মিনার।
সিলেটে সিটি করপোরেশন ও জেলায় প্রায় ১৫শ’ বিদ্যালয় থাকলেও শহীদ মিনার আছে মাত্র ১৯৩টিতে। এর সিংহভাগই পশ্চাদপদ উপজেলা হিসেবে পরিচিত সিলেটের কানাইঘাটে। জেলার জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাটের কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়েই শহীদ মিনার নেই। অন্যদিকে, জেলার মোট ১৩০৭ বিদ্যালয়ে নেই শহীদ মিনার। সংশ্লিষ্টরা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে, শহীদ মিনার না থাকার কারণ ব্যাখ্যা করতে খোঁড়া যুক্তি উপস্থাপন করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বাঙালির আবেগ অনুভূতির কেন্দ্রস্থল শহীদ মিনার। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি ধরে রাখা এবং সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউলসহ সব ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বর্তমান সরকার দেশের প্রতিটি স্কুলে শহীদ মিনার নির্মাণের আহ্বান জানিয়েছিল।
পর্যাপ্ত অর্থ না থাকলেও সরকারের নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, স্কুল মেরামতের কাজের বরাদ্দ থেকে বেঁচে যাওয়া অর্থের সঙ্গে স্থানীয় দাতাদের উদ্বুদ্ধ করে যেন কাজটি করা হয়। এ আহ্বানের প্রতিফলন দেখা যায়নি সিলেট অঞ্চলে।
এজন্য উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে স্থানীয় দাতাদের অনাগ্রহের অজুহাত তুলে ধরছেন। তাদের সেই অজুহাত যে কেবল খোঁড়া যুক্তি তারই প্রমাণ জেলার কানাইঘাট উপজেলা। সিলেট বিভাগের পশ্চাদপদ এলাকা হিসাবে পরিচিত এ উপজেলায় মোট ১৩০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৯০টিতে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আর্থনৈতিকভাবে অনেকটা স্বচ্ছল সিলেট সদর উপজেলায় ১২৫ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯টিতে শহীদ মিনার আছে। প্রথম শ্রেণির উপজেলা খ্যাত গোলাপগঞ্জে ১৮০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে শহীদ মিনার আছে ১৯টিতে, প্রবাসী অধ্যুষিত বিয়ানীবাজারের ১৫০টির বিদ্যালয়ের বিপরীতে ১০টিতে, বালাগঞ্জের ৭২টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ৫টিতে, ওসমানীনগরের ১১০টির মধ্যে ১১টিতে শহীদ মিনার রয়েছে।
সবচেয়ে হতাশাজনক ব্যাপার হলো পাথর কোয়ারি এবং পর্যটনের জন্য বিখ্যাত গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুরে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়েই শহীদ মিনার নেই। শহরতলী দক্ষিণ সুরমায় ১১৬টি বিদ্যালয়ের বিপরীতে শহীদ মিনার আছে মাত্র একটিতে। গোয়াইনঘাটে ১৩৬টি ও জৈন্তাপুরে ৭২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও সেখানে নেই শহীদ মিনার।
এছাড়া, জকিগঞ্জে ২, কোম্পানীগঞ্জে ৯, ফেঞ্চুগঞ্জের ৫ ও বিশ্বনাথের ২০টি বিদ্যালয়ে আছে শহীদ মিনার। সংশ্লিষ্ট এ উপজেলাগুলোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের অনেকে মোবাইল ফোনে কল রিসিভ না করায় মোট স্কুলের সংখ্যাটি জানা যায়নি।
প্রবাসী অধ্যুষিত অন্য উপজেলাগুলো পেছনে ফেলে শহীদ মিনার নির্মাণের ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন প্রসঙ্গে কানাইঘাট উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাস বাংলানিউজকে বলেন, ‘সরকারের আহ্বানের কথা জানিয়ে স্কুলগুলোর ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে স্থানীয় প্রবাসী ও দাতাদের উদ্বুদ্ধ করেছি। এতেই তারা এগিয়ে এসেছেন। কৃতিত্বটা স্থানীয় ও প্রবাসী দাতাদের। ’
সিলেটের গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, বালাগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, দক্ষিণ সুরমা, ওসমানীনগর ও জৈন্তাপুরের উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা যথাক্রমে জহিরুল ইসলাম, রুমান মিয়া, আব্দুর রকিব ভূঁইয়া, প্রতুল, আব্দুর রাজ্জাক ও মো. আব্দুল জলিল তালুকদার শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো বক্তব্য দিয়ে বলেন, ‘গ্রাম-গঞ্জের মানুষ শহীদ মিনার নিয়ে অত আগ্রহী নয়, আর এখাতে নাকি সরকারি বরাদ্দও নেই। ’ তবে তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে দাবি করেন। কানাইঘাটের উদাহরণ টানতেই তাদের অনেকে বললেন, ‘আমাদের চেষ্টারও ত্রুটি নেই। ’
এ বিষয়ে সিলেট জেলা শিক্ষা ঙ্কর্মকর্তাবায়েজিদ খান বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমি বিভিন্ন জেলায় কাজ করেছি। কিন্তু সিলেটের মতো হতাশাজনক চিত্র কোথাও দেখিনি। সরকারের নির্দেশনা ছিল ব্যবস্থা কমিটি ও দাতাদের সহযোগিতায় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংস্কারের টাকা থেকে শহীদ মিনার করার। কিন্তু সিলেটের বেশিরভাগ বিদ্যালয়ে তা হয়নি। অবশ্য প্রত্যেক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ করার ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ’
প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানা, শিক্ষা জীবনের শুরুতেই শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগিয়ে তুলে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে সচেতন নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতেই শহীদ মিনার নির্মাণ জরুরি। এ কারণেই সরকারের নির্দেশনা ছিল প্রতিটি বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ করার, কিন্তু সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতার অভাবে তা আলোর মুখ দেখছে না।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২১
এনইউ/এফএম